ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উখিয়ায় শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে কাঁদলেন তিন নোবেল জয়ী

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

উখিয়ায় শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে কাঁদলেন তিন নোবেল জয়ী

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিন নারী সোমবার দুপুরে একযোগে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তা স্মরণকালের ভয়াবহ। অশ্রুভেজা চোখ ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে শান্তিতে এই তিন নোবেল বিজয়ী নারী রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত বর্বরোচিত ঘটনার জন্য সেদেশের এনএলডি (ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি) নেত্রী আউং সান সুচিকে দায়ী করে বর্বরতম এসব ঘটনার জন্য তাকে আন্তর্জাতিক আদালতে সোপর্দ করে বিচারের দাবিও জানিয়েছেন। নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভের উদ্যোগে ঢাকার নারী পক্ষ সংস্থার সহযোগিতায় এই তিন নোবেল বিজয়ী নারী ৮ দিনের বাংলাদেশ সফরে আসার পর রবিবার প্রথম দফায় আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শন করেন ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান ও যুক্তরাজ্যের মেরেইড ম্যাগুয়ার। সোমবার আসেন ইরানের শিরিন এবাদি। এই তিন নোবেল বিজয়ী সোমবার একযোগে আবার দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়ে উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে এই তিন নোবেল বিজয়ী নারী কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্প পরিদর্শনকালে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে রাখাইন রাজ্যে সেনা, বিজিপি ও সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর কিভাবে হামলে পড়েছে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, গণহত্যা সংঘটিত করেছেÑ এসবের বর্ণনা শুনেন। রোহিঙ্গা যুবতী ও নারীদের কাছ থেকে শুনেন তারা কিভাবে নির্যাতিত হয়েছে। অবহিত হন ধর্ষণের ঘটনাবলীও। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নোবেল বিজয়ী এই তিন নারী বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যেভাবে নির্যাতন চলেছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমতকে আরও সংহত করতে হবে। তারা রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাবলী আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরবেন বলেও আশ্বাস দেন। রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যার বিষয়ে মিয়ানমার নেত্রী আউং সান সুচিকে দায়ী করে তাকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানান। ক্যাম্প পরিদর্শনের আগে জেলা প্রশাসক ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালামের সঙ্গে তারা বৈঠকে বসেন। তারা বৈঠক শেষে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানান, এই তিন নোবেল বিজয়ী নারীকে রোহিঙ্গা ইস্যুর সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর তাদেরকে কিভাবে আশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। নোবেল বিজয়ীরা বাংলাদেশের মানবিকতার প্রশংসা করেছেন। বৈঠক শেষে তারা যান উখিয়ার বালুখালী ও থাইনখালী রোহিঙ্গা আশ্রয় ক্যাম্পে। দিনব্যাপী তারা বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুদের রাখাইন রাজ্য থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা ও সব হারিয়ে অসহায়ত্বের কবলে পড়ার ঘটনাবলী শুনে তারা মর্মাহত হন। আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ॥ তুমব্রু সীমান্তের ওপারের নোম্যান্স ল্যান্ড থেকে রবি ও সোমবার টেকনাফের হারিয়াখালী পয়েন্টসহ বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আরও দুই শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক বলেন, প্রত্যাবাসন চুক্তির পর মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। তাই এখনও প্রতিদিনই নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে এসে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে নয়াপাড়া শিবিরে পাঠানো হচ্ছে। আবেগ-আপ্লুত তিন নারী ॥ শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে চার নারীর তিনজন নির্যাতিত একটি জাতি গোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী কর্তৃক বর্বরতার লোমহর্ষক বর্ণনা শুনেছেন। নোবেলজয়ী অপরজন হচ্ছেন মিয়ানমারের আউং সান সুচি। শান্তিতে নোবেলজয়ী ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান ও যুক্তরাজ্যের মেরেইড ম্যাগুয়ার রবি ও সোমবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন ও নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন খ্যাত আউং সান সুচি এবং দুইদিন ধরে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অবস্থান সরেজমিনে পরিদর্শনকারী তিন নোবেলজয়ী নারীর মধ্যে মমতার পার্থক্য রয়েছে বলে জানান সচেতন মহল। ওই তিন নারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপচারিতা এবং তাদের দুঃখের কাহিনী বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন বলে জানানোর পর অত্যন্ত খুশি হয়েছেন রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও। অভিজ্ঞজনরা বলেন, নোবেল পুরস্কার নেয়ার সময় জয়ীরা উচ্চারণ করেন, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পৃথিবী সৃষ্টি করা যা হবে বাস্তুচ্যুত, গৃহহীন ও নিরাশ মানুষমুক্ত। এমন একটি পৃথিবী সৃষ্টি করতে হবে যার প্রতিটি প্রান্ত হবে সত্যিকার ভয়মুক্ত আশ্রয়স্থল, যেখানে অধিবাসীরা স্বাধীনভাবে ও শান্তিতে বসবাস করার সক্ষমতা রাখবে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এই বিবেকবানের কথায় ২০১২ সালের ১৬ জুন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। অথচ তার (সুচি) দেশেই চলছে একটি জাতি গোষ্ঠীকে গৃহহীন করার অপপ্রয়াস।
×