ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চ আদালতে বাংলা

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

উচ্চ আদালতে বাংলা

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ করে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও যথার্থ। প্রবল আশার কথা এই যে, দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে ইতোমধ্যে বাংলায় রায় লেখা শুরু হয়েছে। এ বিষয়টি এতই প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, তা সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়। ভারতের এ দুটো রাজ্যের বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিচারক ও এ্যাডভোকেটরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে একাধিকবার বাংলাদেশ সফরও করেছেন। সে অবস্থায় উচ্চ আদালতে কেন বাংলা ভাষা প্রচলনসহ বাংলায় রায় লেখা হবে না, তা বোধগম্য নয়। বাস্তবতা হলো, দেশে কয়েক বছরে সার্বিকভাবে শিক্ষার হার বাড়লেও সাধারণ মানুষের বিরাট একটি অংশ এখন পর্যন্ত অন্তত রায় বোঝার মতো বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ নয়। বড়জোর জজসাহেব বা উকিল যেটুকু বোঝান, ততটুকুই বোঝেন। অথচ রায়ের বিষয়টি জানা ও বোঝা সাধারণ মানুষের অধিকার। উচ্চ আদালতেও কেন বাংলায় রায় লেখা হবে না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে বিষয়টি সময় সাপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল টার্মসহ উপযুক্ত পরিভাষানির্ভর, রাতারাতি তা সম্ভব নয় হয়ত। তদুপরি আইন একটি খুবই সুবিস্তৃত ও বহুধাবিভক্ত বিষয়। সেহেতু সময় লাগতেই পারে। আন্তর্জাতিক আদালতসহ সব দেশের অন্তত রেফারেন্সের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সব বইয়ের বঙ্গানুবাদও হয়ত সম্ভব নয়। ইংরেজীসহ কতিপয় টার্ম হয়ত অপরিবর্তনযোগ্যও। সেগুলোর সমন্বয়েই রায় লেখার চেষ্টা করতে হবে বাংলায়। তাতে উপকৃত হবে সর্বস্তরের মানুষ। সম্প্রতি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। অচিরেই আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগেও আরও বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানা গেছে। এতে উচ্চ আদালতে দীর্ঘদিন থেকে জমে থাকা মামলার জট খুলবে নিশ্চয়ই। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আপাতত অন্তত যেখানে যেখানে সম্ভব বাংলা রায় লেখার প্রস্তুতির আহ্বান জানাতে পারেন। এটা হবে ভাষার মাসে ভাষা শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির রয়েছে কয়েক হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-চারুকলা-কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বাংলা ভাষা বর্তমানে সারা বিশ্বে স্বীকৃত অষ্টম ভাষা, যে ভাষায় ২৫ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে ও লিখে থাকে। বাঙালীর ভাষার অধিকার আদায়ের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালীর আত্মত্যাগের দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় ও হচ্ছে। এতে প্রতিটি দেশ ও জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষাসহ নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি-স্বকীয়তা সুরক্ষিত হচ্ছে দিন দিন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, মাসব্যাপী বইমেলায় ভাল বইয়ের অভাব প্রকট। এত দৈন্য, এত অপ্রতুলতা কেন? প্রকাশকরা বলছেন, এ বিষয়ে ভাল গবেষণা ও পা-ুলিপির অভাব প্রকট। আজকাল লেখকরাও কেন যেন পাঠকপ্রিয় ও চটুল বই লেখতে সমধিক আগ্রহী। সিরিয়াস বই লেখালেখিতে তরুণদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। তা কেন হবে? তরুণ প্রজন্ম যদি ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ-কাল-কৃষ্টি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক না জানে, তাহলে সমৃদ্ধ ও স্বশিক্ষিত হবে কিভাবে? শুধু মোবাইল, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকে আসক্ত হলে একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বিজ্ঞান ও মননে যথার্থ অর্থে আধুনিক ও শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে বহু প্রত্যাশিত বইমেলা তরুণ প্রজন্মের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছে না। এখন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অবশ্য কর্তব্য হবে একে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক পরিম-লে মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। উদাহরণত বলা যায়, বইমেলায় বিষয়-বৈচিত্র্যের প্রকট অভাব লক্ষ্য করা যায়। অথচ সারা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কতই না এগিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেও এই চর্চা বাড়াতে হবে বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও আইনবিষয়ক গ্রন্থাদির ওপর মৌলিক রচনা ও অনুবাদের মাধ্যমে। তা না হলে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ব আমরা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সে কথারই প্রতিফলন ঘটেছে।
×