ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রুবেল রেহান

পুষ্প প্রকৃতি প্রেম...

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পুষ্প প্রকৃতি প্রেম...

একুশের ভোর। সাদা শাড়ি, কালো পাড়, নগ্নপদ হেঁটে চলা তরুণী। গন্তব্য শহীদ মিনার। কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।’ উদ্দেশ্য মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবিতে প্রাণ দেয়া পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানো। দৃশ্যটি অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে কি? হ্যাঁ, নিশ্চিত করেই বলা যায় দৃশ্যটি অসম্পূর্ণ। তরুণীর হাতে ফুলের কথা বলা হয়নি যে! কেবল শ্রদ্ধা জানানো নয়, শুভেচ্ছা-প্রেম নিবেদনে ফুলের কি কোন বিকল্প আছে এই ডিজিটাল যুগেও? এখনও নেই, আগেও ছিল না। এক কথায় ফুলের বিকল্প কেবলই ফুল। হরেক রকম বর্ণ-গন্ধ-শোভায় রাঙ্গিয়ে চলেছে মানব হৃদয় সেই অনাদি কাল থেকে। ফুলের জয়গান গেয়েছেন সাহিত্যের অমর স্রষ্টারাও। ফাগুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্র মুকুল/ চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়, বেনুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়...। এত গেল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ফুলের প্রেম। শুধু কী তিনিই? কালে কালে ফুলের প্রেমে কে না পড়েছিল। ফুলের প্রেমে পড়ে কাজী নজরুল গেয়েছিলেন- নয়ন ভরা জল গো তোমার, আঁচল ভরা ফুল/ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল/ ফুল যদি নিই তোমার হাতে, জল রবে গো নয়ন পাতে/অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল...। সত্যিই আমরা প্রেমে ব্যাকুল, প্রেম ভরা হৃদয় ব্যাকুল ফুলের। ফুলের সৌরভ যেমন আমাদের আকৃষ্ট করে, তেমনি সৌরভহীন ফুলও ছড়িয়ে দিতে পারে মনের গভীরে প্রেমের আবহ। সেটা বোঝাতে একটা উদাহরণ মনে পড়ছে। আমেরিকান টিভি চলচ্চিত্র নির্মাতারা তার একটি বিখ্যাত ড্রামা সিরিজে এমনই একটি প্রেমের কাহিনী দেখিয়েছেন। যেখানে দেখা যায় এক আসামি মাইকেল প্রেমে পড়ে জেলের চিকিৎসাকার্যে নিয়োজিত এক সুন্দরী ডাক্তার সারাহ’র। সারাহ’র প্রতি মাইকেলের ভাল লাগার কথা তিনি জানাতে চেয়েছিলেন বিশেষভাবে। হয়ত একটি ফুল হাতে। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়, জেলে তো আর চাইলেই ফুল পাওয়া যায় না। না পাওয়া যাক ফুল, তাই বলে কী আর প্রেম থেমে থাকবে। না থাকেওনি। মাইকেলের কাছে ছিল কিছু কাগজ। ওগুলো কেটেকুটেই বানিয়ে ফেললেন একটি ফুলের অবয়ব। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ওই প্রাণহীন ফুলটাই সারাহ’র মনে দিয়েছিলে প্রেমের দোলা। সে তা খুব যতœ করে রেখেছিল নিজের কাছে। আর সেই প্রাণহীন, সৌরভহীন ফুলটার শেষ আশ্রয় হয়েছিল কোথায় জানেন? প্রিয় মাইকেলের অন্তিম শয়নে! ভালবেসে শেষ উপহার হিসেবে এর চেয়ে দামী কিছুই যে ছিল না সারাহ’র কাছে। প্রকৃতিপ্রেমী বাঙালী প্রকৃতিকে ভালবেসে কাছে টেনেছে, সান্নিধ্য নিয়েছে গাছ, নদী, পাহাড়, সমুদ্র-সৈকতের। তবে বোধকরি সবচেয়ে বেশি নিয়েছে ফুলের। এই তো ক’দিন আগেই গেল পহেলা ফাল্গুন ঠিক তার পরের দিন বিশ্ব ভালবাসা দিবস। যেখানে তরুণ-তরুণী থেকে সব বয়সী মানুষ একসঙ্গে মিশেছে, করেছে আনন্দ-উল্লাস। তবে সব ছাপিয়ে দেখা গেছে তাদের ফুলের কদর। যেন ফুল ছাড়া বসন্ত আর পানিহীন এক খাঁ খাঁ নদী। সেও কি মানা যায়। তাইতো বাঙালীর সাংস্কৃতি আর ইতিহাস ধরে রেখে তারাও সেজেছিল ফুলের সাজে। ফুলেল সাজে ছোট্ট সোনামনিও বাবার কোলে এসেছে বকুলতলায়। নেচে গেয়ে করেছে আনন্দোল্লাস। পৃথিবীর কাছে আগাম জানিয়েছে আমি বাঙালি, এ আমার সাংস্কৃতি, এ আমার ঐতিহ্য, আমিও ভালবাসি ফুলকে, ফুলের সৌরভের মতো শান্তি আর ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে চাই এ ভূমিতে। তবে ফুলের প্রতি মানুষের আগ্রহ কেবল এসব দিনকে ঘিরেই নয়। মানুষের প্রায় দৈনন্দিন জীবনেও ফুলের প্রয়োজন অপরিসীম। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মানুষের শেষকৃত্যেও দরকার পড়ে ফুলের। এখন তো ফুল ছাড়া কোন ঘরোয়া অনুষ্ঠানও চলে না। বাড়ির কোনে ছোট্ট একটু জায়গাতেও শোভা পায় ফুলের গাছ। কেউ কেউ তো শখ করে ছাদের উপরই গড়ে তোলেন ফুলের বাগান। তবে এখন শুধু শখেই সীমাবদ্ধ নেই ফুলের চাষে। বাণিজ্যিকভাবেই গড়ে ওঠেছে অসংখ্য ফুলের বাগান। এর বড় উদাহরণ তো গোলাপ গ্রাম। ফুলের চাষের জন্য যে গ্রামের নাম এখন গোলাপ গ্রাম। এমনই অসংখ্য গ্রাম-মহল্লা রয়েছে ফুলের আবাদের জন্য বিখ্যাত। আর ফুলের মধ্যে গোলাপ নাম কুড়িয়েছে ফুলের রানী হিসেবে। প্রাচীনকাল থেকেই মূলত ফুলের সঙ্গে মানবের সখ্য। প্রচলিত ধারণা আছে, রোমানদের ভালবাসার দেবতা কিউপিড একবার দেবতার বৈঠকে যান এবং উপহার হিসেবে নিয়ে যান অমৃত পরিপূর্ণ গ্লাস! ভুলক্রমে তা পড়ে যায় এবং পৃথিবীতে এসে তা গোলাপ ফুলে পরিণত হয়। রোমানরা বিশ্বাস করত সেটাই ছিল পৃথিবীতে প্রথম গোলাপ গাছ। আরেকটি প্রচলিত ধারণা আছে, গ্রীকদের ভালবাসার দেবতা ক্লোরিস গোলাপ পান মৃত জলপরীর দেহবশে! গ্রীক ভালবাসার দেবতা হিসেবে তার রূপের ছটা দেন, ডাইনোসাস পানীয় দেবতা এতে সুবাস আর সুরভী, বাতাসের দেবতা মেঘে তীব্র বাতাস পরিচালনা করেন যাতে করে সূর্য দেবতা এপোলো গোলাপ ফুল ফোটাতে পারেন! মহা দেবতা তাদের এই সৃষ্টিকে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং গোলাপকে ফুলের রানী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এছাড়াও প্রাচীন ভেনাসবাসীর কাছে গোলাপ ছিল শুদ্ধতা আর পবিত্রতার প্রতীক। ফুলের রং ও সুবাস যেমনি হৃদয়-মন ভরিয়ে দেয় তেমনি বাড়িয়ে দেয় সৌন্দর্য। নিজেকে সাজিয়ে তুলতে অনেকেই ফুলকে অনুষঙ্গ বানান। কেউ খোঁপায় ফুল গোঁজেন, কেউ হাতে জড়ান বেলি কিংবা বকুল ফুলের মালা। তবে শুধুমাত্র সাজার জন্য নয়, ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি এখন ব্যবহৃত হয় ফুল। গোলাপ, ক্যামেলিয়া, শাপলা, বেলি কিংবা জবা। ফুলের মধ্যেই রয়েছে ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল করার এক অনন্য উপাদান। আজকাল তো চুলের যতেœও ব্যবহৃত হয় ফুল। তার থেকেও বড় কথা হলো এখন মনোবিজ্ঞানীরা বাড়িতে ফুলের বাগান করার ক্ষেত্রে মানুষকে আকৃষ্ট করছে। সার্বক্ষণিক ফুলের সুবাস দেহ মনকেও রাখতে পারে সুস্থ ও স্বাভাবিক।
×