ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘গুরুখ্যাত কোচ’ ওয়াজেদ গাজীর অবস্থা গুরুতর

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

‘গুরুখ্যাত কোচ’ ওয়াজেদ গাজীর অবস্থা গুরুতর

জাহিদ রহমান ॥ বর্তমান সময়ে কর্পোরেট গন্ধে ভীষণ মৌ মৌ আমাদের ফুটবলাঙ্গন। অর্থকড়ি এখন বাফুফের দরজায় গড়াগড়ি খায় বললেও ভুল হবে না। ফুটবলের বাহ্যিক আভিজাত্যও এখন আগের তুলনায় কয়েকর শ’ত গুণ বেশি। কিন্তু ঠিক এই সময়ে দেশের এক বর্ষীয়ান ফুটবল কোচ অনাদরে অবহেলায় থাকবেন, চিকিৎসার টাকা পাবেন না- এটি ঠিক মানায় না, বিস্ময়করও মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। বলছি সাবেক তারকা ফুটবলার, ঢাকার মাঠের বহুদিনের পরিচিত প্রবীণ প্রিয় ফুটবলার, কোচ ওয়াজেদ গাজীর কথা। এই বছর কয়েক আগেও যিনি ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্য এক মুখ, তিনি এখন অসুস্থতার শিকার হয়ে অনেকটাই আড়ালে-আবডালে চলে গেছেন। কেউ আর এখন তার খোঁজখবর রাখেন না। মৃত্যুর দ্বার প্রান্তেই তিনি। অসুখে-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে জীবনটা তার ছিন্নভিন্নই হয়ে গেছে। জীবনের এমনতরো অবস্থায় সবাই যেন তাকে ভুলেও গেছে। ওয়াজেদ গাজীর শেষ ঠিকানা এখন বড় মেয়ে শাহানা ইয়াসমিন বুলুর বাড়িতে। ওখানেই থাকেন। সারাজীবন ফুটবলের সঙ্গে থাকার কারণে নিজ সংসারটাকেও মজবুত করতে পারেনি। নানা ঘটনাপ্রবাহে সংসারটাও তার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। যশোর শহরে বারান্দিপাড়াতে নিজের যে বাড়িটি ছিল দুই ছেলে মিলে সে বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছে। তার দুই ছেলের নাম হাসান গাজী ও গাজী আক্তার হোসেন। বড় মেয়ে শাহানাও আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল নয়। টানাটানির সংসার তারও। তবু প্রিয় পিতাকে তো আর মেয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারেন না। মেয়ের কোলেই তার ঠাঁই হয়েছে। মেয়ে আর নাতিপুতিরাই এখন তার দেখভাল করেন। দুই ছেলে দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে না উঠার কারণে দুঃখের পাহাড় তার ওপর ভর করেছে বললে ভুল হবে না। টানা চারদশক বছর ধরে তিনি ছিলেন ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে। কোচিং গুরু হিসেবেই খ্যাত হয়েছিলেন। জীবনের সবকিছু ভুলে ফুটবলকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর তাই যতদিন শরীর চলত ততদিন ফুটবলের উন্নয়নেই নিবেদিত থেকেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্তও জীবনের প্রতিটি মিনিট, সেকেন্ড সময় তিনি ক্ষয় করেছেন ফুটবলের জন্যেই। ফুটবলের প্রতি ভীষণরকম অনুরক্ত থাকার কারণে বাড়িঘর আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে বসতি গড়ে তুলেছিলেন ঢাকার ক্লাব পাড়াতেই। ক্লাবেই থাকতেন, ঘুমুতেন। এভাবেই চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পাড়ি দেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে ক্লাব আর ফুটবলের সঙ্গে সব প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে তাকে চলে যেতে হয় নিজ বসতি যশোরে। সত্তুর দশকের শেষ ভাগ থেকে প্রফেশনাল কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গাজী ওয়াজেদ। প্রথম মাঝারি দলগুলোতে কোচিং করাতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। আর এ কারণেই বড় দুই ক্লাব নিয়ে তিনি খুব আগ্রহী হতেন না। জীবনের বড় সময় ধরেই তিনি কোচিং করিয়েছেন ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা, শেখ রাসেল ক্লাবকে। বিজেএমসির উপদেষ্টা কোচও ছিলেন তিনি। আশির দশকের তারকা ফুটবলারদের বেশিরভাগ কোন না কোনভাবে তার কোচিং পেয়েছেন। তারকা ফুটবলার মঞ্জু, নান্নু, অলোক আশীষ, জনি, আলফাজসহ অনেক তারকা ফুটবলারই তাকে গুরু হিসেবে পেয়েছেন। কোচিং পেশায় আশার আগে ওয়াজেদ গাজী ছিলেন ফুটবলার হিসেবেও খ্যাত। ফুটবলে হাতেখড়িটা ছিল পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে। বাবার চাকরির সুবাদে ওখানেই থাকতেন। পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগে কলকাতা লীগে তার অভিষেক ঘটেছিল। ৬৩ সালে কলকাতা মোহামেডানে খেলেন। এরপর বিজিপ্রেস, ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি, ঢাকা মোহামেডানে দাপটের সঙ্গে খেলে ৭৭ সালে ফুটবল থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেন। পরের বছরই কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথমে যশোরে কোচিং শুরু করলেও পরে রহমতগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের দায়িত্ব নেন। টানা ৮৩ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জেই কাটান। এরপর দুবছর আরামবাগ ক্লাবের কোচ নিযুক্ত হন। ৮৬ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন। এরপর শেখ রাসেল, বিজেএমসি ক্লাবের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন। বিজেএমসির উপদেষ্টা কোচ হিসেবে থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে প্রথম অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের সহযোগিতায় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে আবার মাঠে ফেরেন। কিন্তু বিধি বাম। গত বছর ফের অসুস্থ হয়ে ওয়াজেদ গাজী সর্বশেষ যশোরে চলে যান। আর ফিরে আসতে পারেননি ঢাকার প্রিয় ক্লাব পাড়ায়। কোচ ওয়াজেদ গাজী এখন যশোরেই থাকেন। ভীষণ নিঃসঙ্গ এক জীবনযাপন করছেন। যেন বেঁচে আছেন কেবলই ঈশ্বরের কৃপায়। বার্ধক্য আর অসুস্থতাজনিত কারণে এখন আর সেভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন যশোর শহরে কারবালা এলাকায় নাতির মুদি দোকান ‘নিউ মালিহা স্টোর’-এ। যশোর সরকারী মহিলা কলেজের সামনে গেলে ওখানেই তাকে পাওয়া যায়। তবে তাকে দেখলেই যে কারোরই মন খারাপ না হয়ে পারবে না। এখন আর ভাল করে কথা বলতে পারে না। স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার কারণে পুরনো কথাও আর মনে করতে পারেন না। চলতে-ফিরতেও খুব কষ্ট হয়। শরীরটাও শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করলে শুধু তাকিয়ে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি মনে করে হেসে উঠেন। অনেক অব্যস্ত কথা বলার চেষ্টা করেন। ওয়াজেদ গাজীর দুঃখটা এখন বড় বেশি ভারি বললে ভুল হবে ন। জীবনের এই দুঃসময়ে যেন কেউই তার পাশে নেই। আর্থিক অনটনের কারণে তার চিকিৎসা বিঘিœত হচ্ছে। ওষুধ-পথ্য কেনার টানা নেই। মেয়ের সংসারে অনেকটাই তিনি এখন বাড়তি ঝামেলা। পুরো জীবনটা ফুটবলের জন্য উৎসর্গ করলেও তার দুঃখের দিনে তিনি কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না। কী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা তিনি যেসব ক্লাবে বছরের পর বছর কোচিং করিয়েছেন কেউই তার পাশে সেভাবে দাঁড়ায়নি। ওয়াজেদ গাজীর নাতি তারিফ হোসেন বাবু জানান আর্থিক সহযোগিতার জন্যে বাফুফেসহ আরামবাগ, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে চিঠি লিখলেও কোন সাড়া মেলেনি। এদিকে ওয়াজেদ গাজীর সঙ্গে নাকি সবচেয়ে বড় মশকরাটা করেছে যশোর জেলা প্রশাসকের অফিস। গতবছর তার দায়দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিয়ে একদফায় কয়েক কেজি চাল- তেল সহযোগিতা দিয়ে আর কোন খোঁজখবর রাখেননি। সাবেক ফুটবল কোচ ওয়াজেদ গাজী যে দুঃসহ কষ্টকর জীবনযাপন করছেন সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এ মুহূর্তে বাফুফে, এনএসসিসহ সবারই উচিত তার পাশে দাঁড়ানো। দেশের ফুটবলে যার অসামান্য অবদান শেষ সময়ে তাকে অসম্মান করার কোন যুক্তি নেই।
×