ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাজা পাবেন কাজীও ॥ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১০ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের পর্যালোচনা সভা

বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ অনুসারে একজন ছেলে ও মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১ ও ১৮ হলেও বাংলাদেশে এ বয়স সীমার নিচে ৫২ শতাংশ মেয়ের বিবাহ হয়ে থাকে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট’ ১০টি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করছে। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গবর্নমেন্ট ইনোভেশন ইউনিটের মহাপরিচালক আব্দুল হালিমের সভাপতিত্বে বাল্যবিবাহ নিরোধ সংক্রান্ত নির্দেশনার অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দেয়া পূর্বের ৫৭টি নির্দেশনাগুলো সর্বশেষ অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। ১০টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত থেকে সেসব নির্দেশনার অগ্রগতি জানান। সভায় জানানো হয়, বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। সাজা পাবেন কাজীও। কারণ কাজী বিয়ে না পড়ালেই বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব। সভায় আরও জানানো হয়, নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে কোন বিয়ে সম্পন্ন হবে না সেইসঙ্গে তালাকও গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে এ বিষয়ে। দেশের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এছাড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পর সেসব পরিবারকে মনিটরিংয়ে রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। জিআইইউর গবেষণা অনুসারে, বাল্যবিবাহের কারণসমূহ হলো- বিবাহের সহজ পদ্ধতি, বিবাহ সম্পাদিত হলে বয়সের কারণে তা কোনভাবে অবৈধ বা বাতিল না হওয়া, বিবাহের সময় প্রয়োজসীয় কাগজ-পত্রাদি যাচাই ও সংরক্ষণ না করা, বিবাহের একটি বড় অংশ নিবন্ধিত না হওয়া, সরকারী লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত বিবাহ পড়ানোয় সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গকে সচেতন না করা, এফিডেভিট ও কোর্ট ম্যারেজের বিষয়ে ভুল ধারণা ও বিবাহকে সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে করা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্নমেন্ট ইনোভেশন ইউনিটের মহাপরিচালক আব্দুল হালিমের জানান, সাধারণত মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, ধর্মীয় শিক্ষক, মৌলভি, ঠাকুর, পুরোহিত, স্থানীয় মুরব্বি, বিবাহ নিবন্ধকের সহকারীরা বিয়ে পড়িয়ে থাকেন। তারা যদি আপত্তি করেন তবে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সহজ। তাই যারা বিবাহ পড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকেন তাদের চিহ্নিত করে ৬৪ হাজার ৭৬৪ ব্যক্তির ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানিয়ে ইতোমধ্যেই ২০ হাজার ইমামকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে। সেইসঙ্গে কাজীরা যেন বিবাহ পড়ানোর সময় অবশ্যই পাত্রীর জন্মনিবন্ধন ভালভাবে পরীক্ষা করার বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যাতে তারা জাল সার্টিফিকেট অনুসারে বিবাহ না পড়ান। এছাড়া কাবিননামায় বর-কনের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সকল মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করলে অবশ্যই আমরা প্রধানমন্ত্রীর বাল্যবিবাহ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পালনে আমরা সফল হবো বলে আশা রাখছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেয়া নির্দেশনাগুলো ইতোমধ্যেই আইন ও বিচার বিভাগ, আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, ধর্ম মন্ত্রণালয়/ইসলামিক ফাউন্ডেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদফতর যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এসব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উক্ত সভায় উপস্থিত থেকে স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি তুলে ধরেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক চলমান নির্দেশনার অগ্রগতির সর্বশেষ তথ্যমতে, ‘শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধকল্পে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ কর্মসূচি’তে কাজীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আইনানুগভাবে বিবাহ সম্পাদন ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার চালাতে ১৮টি বৃহত্তর জেলায় কনসালটেশন করা হয়েছে এবং ৪৮০টি উপজেলায় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। এবং বাল্যবিবাহ ৫২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যক্রম চলমান। সেইসঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এনাবেলিং এনভাইরনমেন্ট চাইল্ড রাইট (ইইসিআর) প্রকল্পের মাধ্যমে অসহায়, দরিদ্র ও বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে এমন মেয়ে শিশুদের বিশেষ সহায়তা প্রদান ও তাদের স্বাবলম্বী করতে ৬-১৫ বছর বয়সী ১০ হাজার ৪২৫ শিশুর প্রত্যেককেই ৩৬ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে কন্যাশিশুর সংখ্যা ৫ হাজার ৯২১। এ টাকা প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা হিসাবে ৬ মাস পর পর ৩ কিস্তিতে প্রদান করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের ৩ লাখ মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লিফলেট পুস্তিকা ও কনটেন্ট তৈরি করে খতিব ইমামদের বিতরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক ১ হাজার ৮০০ মসজিদের ইমামকে বাল্যবিবাহ নিরোধ সংক্রান্ত খুৎবার পূর্বে বক্তব্য প্রেরণ করা হয়েছে এবং মসজিদে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত পল্লী সমাজসেবা (আরএসএস) কার্যক্রম দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালায় বাল্যবিবাহ নিরোধ ও যৌতুক প্রতিরোধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে শিশু নির্যাতন ও প্রতিরোধে চালু হেল্পলাইন ১০৯৮ এর বিষয়ে আলোচনা, প্রচার ও সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি বিষয়ক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আরও জানানো হয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ১০০টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে। সভায় এ অধিদফতরকে বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পর নিরাপত্তা প্রদানের জন্য যদি কোন কিশোরীর পরিবার তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে থাকে তবে তাদের ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত শেষ রাসেল শিশু পরিবারে রাখার ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেয়া হয়। বাল্যবিবাহ পড়ানোর শাস্তি ও বিবাহ নিবন্ধনে তার দায়িত্ব কী, তা নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা, বিয়ে পড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মচারীদের নিরুৎসাহিত করে জারিকৃত পরিপত্রের সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের জন্য এটি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের চেকলিস্টভুক্ত করে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়া, বিভিন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ট্রেনিং মডিউলে আইনানুগভাবে বিবাহ অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী অন্তর্ভুক্ত করে তা শিক্ষকদের জানানো; শিশু বিবাহের ফলে যেন কোন ছাত্রী ঝরে পড়তে না পারে সে জন্য শিক্ষকদের সচেতন করার বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বাল্যবিবাহ নিরোধ ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীতা তুলে ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্যচিত্র/অনুষ্ঠান প্রচার অব্যাহত রাখা, আইন ও বিচার বিভাগ, আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাল্যবিবাহের বিপক্ষে প্রচারের জন্য কোন তথ্যচিত্র বা বিজ্ঞাপন তৈরি করলে তা বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করা। যৌন হয়রানি বন্ধসহ শিশু-কিশোরীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয়ভাবে নিয়োজিত সব সংস্থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা; অসহায় দরিদ্র ও বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে এমন শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট ২০১৩ সাল থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ শুরু করে। বিভাগীয় কমিশনারদের পাঠানো তথ্যের হিসাব রাখে এই ইউনিট। তাদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনা ছিল ১৩ হাজার ৩৩৪টি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ১৫ হাজার ৭৭৫টি। অবশ্য ২০১৬ সালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনা কমে আসে, ৬ হাজার ৩৮৯টি। জিআইইউয়ের তথ্য মতে, ‘উদ্ভাবনী উপায়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ, মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা’ শীর্ষক ২৩টি কর্মশালা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মতবিনিময় সভা, কর্মশালা, নীতি নির্ধারণী সভা ছাড়াও জুলাই ২০১৬ হতে মার্চ ২০১৭ সময়কালে স্থানীয় সরকার এবং ২০০ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলাভিত্তিক বাল্যবিবাহ নিরোধ কৌশল ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এসব অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ২৬ হাজার ২৬৫ জন অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া প্রতি মাসে দেশের ডাটাবেজভুক্ত বিবাহ নিবন্ধক ব্যতীত বিবাহ পড়ানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।
×