ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা

মার্চেই উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মার্চেই উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি

এম শাহজাহান ॥ স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থেকে বেরিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল মর্যাদার ‘স্বীকৃতিপত্র’ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্য মার্চে জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোস্যাল কাউন্সিলের (ইউএনসিডিপি) চার দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক সভায় বাংলাদেশের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। এর পরই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেয়া হবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতিপত্র। স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত (এলডিসি) উত্তরণ পর্বটি জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনার পর উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়টি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থান আরও সুসংহত হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণবাজার থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে। এতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে এবং সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে ছোটখাটো কিছু চ্যালেঞ্জও যুক্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা কঠিন হতে পারে। এছাড়া রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধার বিষয়টি নিয়ে নতুন কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় এলডিসি দেশের সুযোগ অব্যাহত রাখতে পারবে বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণা করে তালিকা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে। একটি হচ্ছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ এখন থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হবে। প্রতিবছর ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে দেশগুলোকে চারটি আয় গ্রুপে ভাগ করে। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই প্রতিফলন ও স্বীকৃতি এটি। জাতি হিসেবে এটি অবশ্যই একটি বড় অর্জন ও মাইলফলকও বটে। এটির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনি বাস্তবেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি রয়েছে। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের পর যেসব সমস্যা তৈরি হবে তা কাটিয়ে উঠতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। আগামী মাসে জাতিসংঘের ত্রিবার্ষিক সভায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতদিন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলো থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধাসহ নমনীয় হারে উন্নয়ন সহায়তা পেয়ে আসছে। এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের অনুকূলে এসব বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা যাতে কোনভাবে হ্রাস না পায় সেজন্য কাজ শুরু করেছে সরকার। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মর্যাদার। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। জানা গেছে, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতের ঘোষণা উপলক্ষে আগামী ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। একই সঙ্গে ওইদিন থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সেবা সপ্তাহসহ নানা কর্মসূচী পালন করবে। এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের বিষয়টি উদযাপনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত সভা শেষে সম্প্রতি সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ১৬ থেকে ১৮ মার্চের মধ্যে যে কোনদিন জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র দিতে পারে। ওই সময় তিনি আরও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতে যে তিনটি সূচক রয়েছে, সবটাতেই বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে এগিয়ে। এজন্য উন্নয়নশীল দেশে যেতে আর কোন বাধা নেই। তিনি বলেন, মার্চ মাসে একটি ‘ডিক্লারেশন’ হবে। এজন্য একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সে দিনটিতে নানা ধরনের কর্মসূচী পালন করা হবে। এর মধ্যে শোভাযাত্রা (র‌্যালি) ও আনন্দ মিছিল করবে বাংলাদেশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। এছাড়া এ উপলক্ষে একটি সেবা সপ্তাহ পালন করা হবে। তিনি বলেন, সবকিছুই হবে সেদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। জানা গেছে, গত ২২ জানুয়ারি গণভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি অবহিত করা হয়। একই সঙ্গে এ অর্জনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপনের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরবর্তীতে ২২-২৬ মার্চ পর্যন্ত উৎসব উদযাপন কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এলডিসি সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স ৩১ জানুয়ারি পৃথক একটি বৈঠক করে। মূলত ওই বৈঠকেই দীর্ঘতম উৎসবের কর্মসূচী প্রণয়ন ও কারা-কিভাবে-কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে, তার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তৈরি করা এ সংক্রান্ত এক কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, উৎসব উদযাপন পর্বটি শুরু হবে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার মধ্য দিয়ে। ২২ মার্চ সকালে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ যৌথভাবে এ সংবর্ধনার আয়োজন করবে। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের এলডিসি স্ট্যাটাস উত্তরণে জাতিসংঘের দেয়া স্বীকৃতিপত্রও হস্তান্তর করা হবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। পরে এ সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরুর পর উন্নয়নের এ স্তরে উত্তরণ ও জাতিসংঘের স্বীকৃতিপত্র গ্রহণ পর্যন্ত একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হবে। এ অনুষ্ঠানে স্মারক ডাক টিকেটও উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এতে এলডিসি উত্তরণ উপলক্ষে প্রকাশ করা বিশেষ স্মরণিকাও বিতরণ করা হবে। এছাড়া ঢাকা শহরকে চারটি জোনে ভাগ করে নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্ব স্ব উদ্যোগে এ র‌্যালি বের করবে এবং রাজধানী প্রদক্ষিণ করবে। সন্ধ্যাকালীন কর্মসূচীতে থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হওয়া এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এতে সমবেতরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। অনুষ্ঠানে ৫-৭ মিনিটের একটি লেজার শো এবং ১০-১২ মিনিটের একটি ফায়ার ওয়ার্কস পরিবেশিত হবে। পুরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে দুই ঘণ্টাব্যাপী। ২৩ মার্চ দিনব্যাপী আয়োজন করা হবে আন্তর্জাতিক সেমিনার। সকাল ১০ টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও এনজিও ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী মাসে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রথম স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অগ্রগতি যেভাবে আছে, তার কোন বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। এটি যেমন মর্যাদার তেমনি এর সঙ্গে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। দেখার বিষয়, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটা দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। এটা ঠিক, এই স্বীকৃতির বড় বিষয় মর্যাদার। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার সুবিধা পায় তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক ঋণে কম সুদ ও নমনীয় শর্তও সীমিত হয়ে আসবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১ প্রণয়ন করে। সেখানে রয়েছে ২০২১ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষার কথা। বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের লক্ষ্য মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলার করা। সরকারের পরিকল্পনায় আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে বিশ্বের ২৩ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এই অবস্থান ৩৮ তম। সিটি গ্রুপের বিবেচনায়ও ২০১০ হতে ২০৫০ কালপর্বে বিশ্বের যে ১১টি দেশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে শীর্ষ পর্যায়ে থাকবে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে জেপি মরগানের ফ্রন্টিয়ার ফাইভ তালিকাতেও স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিকমানের রেটিং এজেন্সি কর্তৃক সার্বভৌম ঋণমান মূল্যায়নে বাংলাদেশ সন্তোষজনক ঋণমান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
×