ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ

(গতকালের পর) দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি মেক্সিকোর কানকুনে ‘গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন-২০১৭’ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। সম্মেলনে দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশের প্রস্তুতিরও প্রশংসা করেছেন বিশ্ব নেতারা। দুর্যোগে উপকূলবাসীর আশ্রয়ের জন্য অসংখ্য সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর, রোয়ানুর বিষয়ে সতর্ক করে দেয়ার পরও শুধু অসচেতনতায় কিছু প্রাণহানি ঘটেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বড়মাপের ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা এখন আগের চেয়ে বেশি। আর এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী ধনী রাষ্ট্রগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। ধনী রাষ্ট্রগুলোকে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্যোগ মোকাবেলায় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে সক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ দিন বদলের নয় বছরে নতুন নতুন কূপ খননসহ গ্যাস সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমানে ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান সরকারের আমলে ভোলা, সুন্দলপুর, শ্রীকাইল ও রূপগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড সম্প্রসারণ এবং বিবিয়ানা-ধনুয়া গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। হবিগঞ্জের মুচাই এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। গ্যাস নেটওয়ার্ক রাজশাহীতে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্র এলাকায় গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং উৎপাদন কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে সাফল্য বাংলাদেশ মূলত কৃষি প্রধান দেশ হলেও অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রফতানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১%। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) ১ হাজার ১৯৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ে চেয়ে ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর ৩ হাজার ১৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এদিকে মোট রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। সত্তর দশকে রোপিত তৈরি পোশাক শিল্প নামক ছোট্ট চারাগাছটি আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মহীরুহ। দেশের রফতানি আয়ের ৮২-৮৫% এই খাত থেকে আসে। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত ইউরোপ, আমেরিকার বাজার জয় করে এখন রাশিয়ার দিকে ধাবমান। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজারো উদ্যোক্তা এবং লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তার অবস্থান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয়ের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে এই খাতের অগ্রযাত্রা আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করবে। পর্যটন খাতে সাফল্য সরকারের নয় বছরে তৈরি পোশাক শিল্প খাতের পর পর্যটন খাত রাজস্ব আদায়ের বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে । গত বছর অর্থাৎ ২০১৬-২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে দেশী-বিদেশী সবধরনের পর্যটক রয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। তিন পার্বত্য জেলা ও সিলেট অঞ্চলজুড়ে রয়েছে প্রকৃতির লীলাভূমি। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত সমৃদ্ধ কক্সবাজার। এছাড়া বেশকিছু ঐতিহাসিক ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনও আছে, যা পর্যটকদের মনে আগ্রহ জাগাতে পারে। দিনে দিনে বাংলাদেশে পর্যটনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে দারুণ সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে । ২০১৬-২০১৮ পর্যন্ত তিন বছরকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করে নানা উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে গত নয় বছরে ছয় হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাত জিডিপিতে ২ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পর্যটকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করায় এ খাতে প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এ খাতে বর্তমান সময়ে উড়াল দেয়ার জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ। আর বর্তমান সরকারের শাসনামলে এটি একটি অন্যতম সাফল্য। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের চেহারাই অনেকটা বদলে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সাফল্য জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার পরও নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের কোন দেশের নিজস্ব তহবিলে এ ধরনের ফান্ড গঠনের কোন নজির নেই। এ পর্যন্ত এই ট্রাস্ট ফান্ডকে সরকারী তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া ৩ হাজার কোটি টাকায় গ্রহণ করা হয়েছে ৩৬৮টি প্রকল্প। পাশাপাশি বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটিও বিশ্বে প্রথম। প্রণয়ন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইনসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা। আর এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া হয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, অনিয়মিত ও অতি বৃষ্টিপাত, বন্যা, নদী তীরের ভাঙন, খরা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ভূমিধস এবং কৃষি উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের মতো জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের এই সাফল্য উন্নত বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় ও ছিটমহল বিনিময় কোন রকম বৈরিতা ছাড়াই দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র বিজয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকার প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহীসোপান নিয়ে জাতিসংঘে চলমান মামলায়ও ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল নাগাদ এ মামলার রায় হতে পারে। ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশ যাতে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতায় না ভোগে, সে জন্য দেশটির সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সই এবং এর নবায়ন বাংলাদেশের বড় সফলতা। এ ছাড়া স্বাধীনতার পরপর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি হয়েছিল সম্প্রতি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা শেখ হাসিনার সরকারের বড় অর্জন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও বড় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত সশস্ত্র পাহাড়ীদের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি ওই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে। পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমছে। সেখানে শিক্ষার বিস্তার এবং জীবনমানের পরিবর্তন ঘটছে। শেখ হাসিনার সরকার বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছে সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুত্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন দেশের ভেতর-বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়ানো খেটে খাওয়া মানুষের লড়াকু নেত্রী-মমতাময়ী শেখ হাসিনা। নিজভূমে আশ্রয় প্রত্যাশী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তায় বিশ্বজনমত গঠনের মতো মহান কিন্তু কঠিন সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও প্রশংসিত। (সমাপ্ত) লেখক : গবেষক [email protected]
×