ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিরঞ্জন রায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে মামলাই একমাত্র পথ

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে মামলাই একমাত্র পথ

[ গত দুই পর্বে (১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি চতুরঙ্গ পাতায়) বিশ্বে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনসহ অন্যান্য আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অপরাপর ব্যাংকের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির দু’বছর পর এই অর্থ উদ্ধারে ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি। উঠে এসেছে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের ভূমিকা। প্রসঙ্গক্রমে বিশ্বে লাইবর রেট কেলেঙ্কারি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে জালিয়াতি, সাবপ্রাইম মর্টগেজ জালিয়াতিসহ অনেক বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধে মামলা এবং বিশ্বের অনেক বৃহৎ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনেছে এই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এসব অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় কি সে ব্যাপারেও বক্তব্য দেয়া হয়েছে। আজ ‘পর্ব তিন’ মানে শেষ পর্ব] ইকুয়েডোরের ব্যাংকের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা প্রয়োজন : বাংলাদেশ ব্যাংকের মতোই ইকুয়েডোরের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যাংকো ডেল এসটারডো (বিএলডি) এরকম অনলাইন হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে তাদের ১২ বিলিয়ন ডলার গচ্চা দেয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আগে আরও দুটি দেশের ব্যাংকে এরকম অনলাইন হ্যাকিং সংঘটিত হয়েছিল। প্রথমে ভিয়েতনামের একটি ব্যাংকে হ্যাকিং প্রচেষ্টা চালানো হয়; কিন্তু সেই ব্যাংকের অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে সেটি সফল হতে পারেনি। এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ইকুয়েডোরের বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যাংকো ডেল এসটারডোর সার্ভারে হ্যাকিং করে ভুয়া সুইফট মেসেজ পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের নসট্রো হিসাবে গচ্ছিত অর্থ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। এখানেও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের মতো ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক ভুয়া সুইফট মেসেজের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকো ডেল এসটারডোর ১২ মিলিয়ন ডলার হংকং স্থানান্তর করে এবং সেই অর্থ পরবর্তীতে সেখানকার চারটি কোম্পানি আত্মসাত করে। বিষয়টি জানার পর ব্যাংকো ডেল এসটারডো উক্ত অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের কাছে দাবি করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বৃহত্তম ব্যাংক ওয়েলস ফার্গো সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে উল্টো ব্যাংকো ডেল এসটারডোকে দোষারোপ করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে তারা উল্লেখ করে যে, প্রাপ্ত সুইফট মেসেজের ওপর ভিত্তি করে তারা অর্থ স্থানান্তর করেছে, তাই এ ব্যাপারে তাদের কোনরকম দায় নেই। ব্যাংকো ডেল এসটারডো মোটেই বসে থাকার পাত্র নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক প্রথম দিকে মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলার ব্যাংকো ডেল এসটারডোকে ফেরত দিলেও বাকি ৯ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় এই অজুহাতে যে, এই অর্থ হংকং স্থানান্তর হয়ে গেছে। ফলে কালবিলম্ব না করে ব্যাংকো ডেল এসটারডো যুগপৎভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে এবং হংকংয়ের আদালতে এই ৯ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারের প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করে। প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলাটি চলা নিয়ে বিভিন্ন আইনজীবী এবং অভিজ্ঞ মহলের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলাটি প্রত্যাহারের জোরালো আবেদন জানায় ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের আইনজীবী। কিন্তু ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক লিউইস কাপলান মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। মামলাটি এখনও বিচারাধীন আছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক সেই তিনটি মধ্যস্থতাকারী (ইনটারমিডিয়ারি ব্যাংক) ব্যাংকের একটি যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের হিসাবে জমা করেছিল। যেহেতু অপরাধের ধরন এবং আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি এককই রকমের, তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এই চলমান মামলার বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করা। প্রয়োজনে ইকুয়েডোরের ব্যাংকো ডেল এসটারডোর পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এতে করে তারা ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন। রিজার্ভ জালিয়াতির এই অর্থ আদায় করা বাংলাদেশ ব্যাংকের নৈতিক ও প্রধানতম দায়িত্ব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই অর্থে অংশ রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকের ঘাম ঝরানো উপার্জন। এমনকি আমরা যারা উন্নত দেশে বসবাস করছি তাদের মধ্যে সৌভাগ্যবান দু-একজনের কথা বাদ দিলে অধিকাংশই দেশের অভিজাত সমাজ থেকে এসব দেশে এসে যেভাবে কারখানা বা ফাস্টফুডের দোকানে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে তাতে তাদের কষ্টও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকের কষ্টের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আর তাদের এই কষ্টার্জিত অর্থের অংশও রয়েছে এই খোয়া যাওয়া রিজার্ভের মধ্যে। সর্বোপরি দেশের দরিদ্র শ্রমিকের কষ্টে উৎপাদিত পণ্য আমাদের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে বিদেশে রফতানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন তারও একটা অংশ আছে এই চুরি যাওয়া রিজার্ভের মধ্যে। তাই এই অর্থ ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং তা সর্বোচ্চ আদালতের রায় পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। এই উদ্যোগের যথেষ্ট সুযোগ এবং তথ্য-প্রমাণ বিদ্যমান আছে। এজন্য রিজ্যাল ব্যাংকের হাতে যে প্রমাণ আছে তাই যথেষ্ট, আর নতুন করে কোন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন হবে না। তারা সুইফটের মাধ্যমে এই অর্থ গ্রহণ করেছে, তাদের ব্যাংকে অবৈধ বা ভুয়া হিসাব খুলে এই অর্থ প্রদান করেছে। এসব ঘটনার দায় স্বীকার করে এই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদত্যাগ করেছেন এবং অন্য দোষীদের শাস্তি প্রদান করেছে। এই ব্যাংক যেহেতু নিজেরাই দোষ স্বীকার করে এত সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তাই এখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অর্থ ফেরত দেবে বা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করব এটাই স্বাভাবিক। প্রয়োজন শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় এবং কার্যকর উদ্যোগ যার মাধ্যমে রিজ্যাল ব্যাংককে আইনগতভাবে এই অর্থ ফেরত দিতে বা ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা। বিশ্বে সমস্ত অবৈধ লেনদেনের অর্থ আইনী প্রক্রিয়ায়ই উদ্ধার করা হয়েছে। এ কথা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ উদ্ধারের জন্য বিচারকের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। আইনী বেড়াজালে আটকে ফেলতে পারলে দোষী ব্যক্তি আপনা আপনি অর্থ পরিশোধ করে বাদী পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, যাকে আইনের ভাষায় আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি (আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট) বলে উল্লেখ করা হয় এবং বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ বিচারকরেও এতে সম্মতি থাকে। এই পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি উন্নত বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। কেননা দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভাল করেই জানে যে, আদালতের রায়ে অর্থ পরিশোধ ছাড়াও আরও অন্য শাস্তি হতে পারে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথভাবে উদ্যোগ নিতে পারলে অবশ্যই এই টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সমুদয় অর্থ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। এমনকি চাইলে এতদসংক্রান্ত যে আর্থিক খরচ হবে তাও উদ্ধার করতে পারবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে প্রধান অভিযুক্ত করে এবং সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক যথা দি ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, দি সিটি ব্যাংক এবং ওয়েলস ফার্গো ব্যাংককে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সঠিকভাবে মামলা দায়ের করতে পারে তাহলে রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড চাপে পড়বে। এমনকি তাদের ইউএস ডলার হিসাব পরিচালনা করাও প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়তে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে তারা বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, অবৈধ লেনদেনের অর্থ উদ্ধার হয় সাধারণত দুই পদ্ধতিতে। যদি কোন অর্থ স্থগিত বা ফ্রিজিং অবস্থায় থাকে তবে তা সরাসরি ফেরত পাওয়া যায়। আর বাকিটা দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করা হয়। এই পদ্ধতিতে খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধার করতে হলে আইনী লড়াই ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। তাই অনলাইন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারে মামলাই একমাত্র পথ। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×