ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রমাণ নষ্টের অপচেষ্টা

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রমাণ নষ্টের অপচেষ্টা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত বছরের শেষ দিকে জাতিগত রোহিঙ্গা নিধনপর্বের পর বর্তমানে চলছে সেসব ধ্বংসযজ্ঞ মুছে ফেলার অপচেষ্টা। ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের যেসব গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এখন সেসব বুলডোজার দিয়ে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে মাটির সঙ্গে। এর একটাই উদ্দেশ্য আর তা হলো মিয়ানমার সরকার তথা সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা-গণহত্যা-ধর্ষণ সর্বোপরি পোড়ামাটি নীতির যেন আদৌ কোন চিহ্ন না থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) শুক্রবার সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এই অভিযোগ তুলে ধরেছে উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত সচিত্র তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, নিপীড়িত ও বিতাড়িত অন্তত দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী ইতোমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এর বাইরেও বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চীন-ভারত-রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিগত নিধন তথা গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এর পাশাপাশি বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সে দেশে সম্মানজনক পুনর্বাসনের মানবিক আবেদনও জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স গণমাধ্যমে সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নিধনের সচিত্র বিবরণ দিয়েছে। ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ভ্যাটিকানের পোপ পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের এবং এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তিতে নোবেলজয়ী আউং সান সুচির তীব্র সমালোচনাসহ অবরোধ আরোপ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ গণহত্যার অভিযোগে বিচারের দাবি উঠেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। অনেকটা এই প্রেক্ষাপটেই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ মুছে ফেলার অপচেষ্টা। অবশ্য এতে ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দু’দেশের সর্বশেষ বৈঠকে প্রায় নয় হাজার রোহিঙ্গার পরিবারভিত্তিক তালিকা ঠিকানাসহ তুলে দেয়া হলেও বাস্তবে কোন অগ্রগতি নেই। বরং ছয় মাস অতিবাহিত হলেও নতুন করে প্রতিদিনই আরও রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের খবর আছে। এর পাশাপাশি রাখাইনে নতুন করে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সূত্রে। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের অন্তত ৬০০ একর আবাদি জমিতে নতুন করে ঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর মিলেছে। বাঙ্কার খননসহ অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের খবরও আছে। জাতিসংঘ রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক তদন্ত দল পাঠাতে চাইলেও সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার তার অনুমতি দিচ্ছে না। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ইতোমধ্যে সুচির নানা আন্তর্জাতিক পদক ও সনদ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের পক্ষ থেকে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের অনেক দেশে প্রবেশসহ প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সুপারিশ ও তালিকা অনুযায়ী রাখাইনে বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না করে তাহলে আগামীতে তাদের একঘরে হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তখন মনে হয় না এমনকি চীন, রাশিয়া, ভারতও অন্তত নৈতিক ও মানবিক কারণে সমর্থন দেবে মিয়ানমারকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করেছে। এগুলো হলোÑ সে দেশে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করা; জাতিসংঘ মহাসচিবের অধীনে একটি নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণ; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং তা পূরণে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে, যাদের অধিকাংশ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সর্বোপরি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
×