ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুরনো মেলায় আসছে নতুন নতুন বই কেনার জন্য ভিড়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পুরনো মেলায় আসছে নতুন নতুন বই কেনার জন্য ভিড়

মোরসালিন মিজান ॥ পুরনো হয়েছে মেলা। ২৪তম দিনে এসে বলাই যায়, পুরনো হয়েছে। তবে লেখক পাঠক প্রকাশকের মিলনমেলা এখনও প্রাণবন্ত। শনিবার যথারীতি ছিল শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় শুরু হয়ে যায় মেলা। চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সারাদিনই বই সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন পাঠক। বিভিন্ন বয়সী মানুষ ভিড় করেছিলেন মেলার দুই অংশে। হাতে সময় কম। এরই মধ্যে ভাল বইয়ের খোঁজ করছেন সবাই। তাই কিছু বইয়ের কথাই বলা যাক। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ গল্প’ প্রকাশ করেছে চারুলিপি। অনেক গল্প অপ্রকাশিত অবস্থায় ছিল। জাদুঘর থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে এবারের মেলায় প্রকাশ করা হয়েছে। গল্প বটে। আছে স্মৃতিচারণও। সব মিলিয়ে বইটি তাই সংগ্রহে রাখার মতো। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নতুন বই ‘বিদ্যা সাগর ও অণ্যেরা।’ বরেণ্য লেখক ও বুদ্ধিজীবীর বইয়ের চাহিদা থাকলেও, সে তুলনায় অনেক কম লিখেন তিনি। অন্যপ্রকাশ থেকে আসা বইটি তাই আলাদা গুরুত্বের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, শেখ আবদুর রহিম ও শেখ ফজলুল করিমের ওপর বইতে আলোকপাত করেছেন লেখক। আগামী থেকে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।’ লেখক সিরাজুল ইসলাম মুনির। বৃহদায়তন উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যের মূল্যবান সংযোজন বলা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সম্পাদনায় বের হয়েছে ‘সংসদে তিন প্রজন্ম।’ প্রকাশ করেছে মাতৃভূমি। জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন প্রথম জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত তাঁর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম। দাদা এবং বাবার পথ ধরে জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেন তানভীর শাকিল জয়। বই পাঠে জাতীয় সংসদে এই তিন প্রজন্মের ভূমিকা সম্পর্কে জানা যাবে। মিমির বইয়ের প্রকাশনা উৎসব ॥ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জার্নিম্যান থেকে মেলায় এসেছে নাজনীন হক মিমির ট্র্যাভেল জার্নাল ‘এখওগচঝঊঝ ঙঋ অঝওঅ.’ ইংরেজীতে লেখা বেশ বড়সরো বই। ভ্রমণ সাহিত্য। তবে এ ধরনের লেখায় সাধারণত যেসব বিষয় উঠে আসতে দেখা যায় এটি তা থেকে একটু আলাদা বৈশিষ্ট্যের। এ কারণেই বইটি নিয়ে আগে থেকেই এক ধরনের কৌতুহল তৈরি হয়েছিল। লেখক সম্পর্কে যারা জানেন, তাঁর রুচির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা বইটি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী হবেন। একটি ইংরেজী দৈনিকে নিয়মিত লিখেছেন মিমি। বইয়ে আরও বিস্তারিত। এশিয়া মহাদেশের ১১টি স্পটের ওপর লেখা। ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সাহিত্য স্থাপত্য অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জার নানা উপাদান দিয়ে বইটিকে গড়ে নেয়া হয়েছে। এক ডজনের মতো লেখা। সুন্দর ছবি। পাতা উল্টাতেই মন কেমন নরম হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই শুরু হয়ে যায় ভ্রমণ। শনিবার মেলায় বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হয়। জার্নিম্যানের প্যাভিলিয়নেই ছিল মূল আয়োজন। প্রকাশনা উৎসবে বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, কবি মুহাম্মদ সামাদ, স্থপতি রবিউল হোসাইন, বাচিক শিল্পী হাসান আরিফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উজ্জ্বল উপস্থিতি হলেও, ঘরোয়া আয়োজন। আনুষ্ঠানিকতা ছিল যৎসামান্য। বেশি ছিল আন্তরিকতা। বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান বলেন, বইটি অনন্য সাধারণ। শৈল্পিক গ্রন্থ। এর আগেও মিমি খুব অর্থবহ বই লিখেছে। এবার ট্রাভেল জার্নাল। লেখার পাশাপাশি বইয়ের সজ্জা ছবির ব্যবহার পরিমিতিবোধের প্রশংসা করেন তিনি। মুনতাসীর মামুন বেশ মজা করেই বলেন, নাজনীন হক মিমি দেখতে সুন্দর। তাঁর লেখা সুন্দর। যে বইটি বের হলো সেটি অপূর্ব সুন্দর। আমার মনে হয় না, দেশে আর কোন ট্রাভেল জার্নাল এত সুন্দরভাবে বের হয়েছে। ভ্রমণ সাহিত্যের এখন প্রধান প্রতিন্দন্দ্বী ইন্টারনেট। মিমি বই হাতে সেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। গ্রন্থটি থেকে পাঠক নতুন অনেক চিন্তার নতুন অনেক ভাবনার খোড়াক পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বইটিকে প্রতœ ঐতিহ্য ও ইতিহাসের একটি আঁকড় গ্রন্থ বলা যেতে পারে। এতে আর্কিটেকচার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনÑ এই দুটো দিক বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। সব মিলিয়ে সুখপাঠ্য একটি ট্রাভেল জার্নাল। ‘আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস’ গ্রন্থের উল্লেক করে হাসান আরিফ বলেন, মিমির সেই গ্রন্থ ছিল বেদনার পদাবলী। লিখেছেন। কেঁদেছেন। এবার উল্টো। তিনি তার বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখার আনন্দের অনুভূতির কথা লিখেছেন। আরও অনেকে বললেন। তবে বইয়ের পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরলেন লেখিকা নিজেই। বললেন, আমি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি। প্রত্যেকটি দেশ অনেক বড়। ঢাকা শহরটিও কম বড় নয়। আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব, দেখেছি। সাধ্যমতো লিখেছি। বইতে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, প্রাচীন ঐতিহ্য, স্থাপত্য, অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জা, শিল্প সংস্কৃতির নানা দিক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। বইটি সবার ভাল লাগলেই তাঁর পরিশ্রম সার্থক হবে বলে জানান তিনি। ১৮২ নতুন বই ॥ মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ১৮২টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল ‘দেশ বিভাগের সত্তর বছর’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইমানুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সৈয়দ হাসান ইমাম। সভাপতিত্ব করেন কামাল লোহানী। প্রাবন্ধিক বলেন, দেশভাগের নানা মাত্রার মধ্যে উদ্বাস্তু সমস্যা যেমন একটি, মানুষের মনস্তত্ত্বে বিভাজনও আর একটি দিক। দেশভাগের যে কোন অংশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যালঘু মানুষ। আবার নতুন রাষ্ট্রে বিকাশের পথও খুঁজে নেন অনেকে। দেশভাগের সত্তর বছর পেরিয়ে আমাদের প্রত্যাশা-যতই ভৌগোলিক বিভাজন থাকুক, হৃদয়ে হৃদয়ে যেন কাঁটাতারের বেড়া না গড়ে ওঠে। আলোচক সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, দেশভাগ সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের জন্যই এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। আপন ভিটেমাটি থেকে মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার ক্ষত যেমন কখনোই কোন ক্ষতিপূরণে মুছে যাবার নয়। সভাপতির বক্তব্যে কামাল লোহানী বলেন, আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দেশভাগ রেখে গেছে গভীর অভিঘাত। চলচ্চিত্র ও চিত্রকলাতেও দেশভাগের ছায়া পড়েছে। দেশভাগে সবসময় সুবিধা নেয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হোক আমাদের সকল মানবিক লড়াই। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল নৃত্য সংগঠন ‘ফাল্গুনী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা’র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন তাপসী ঘোষ, মুন্নী কাদের, ফারহানা শিরিন, মোক্তার হোসেন এবং এম এম উম্মে রুমা ট্রকি।
×