ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা স্বর্ণ কিনতে চান ব্যবসায়ীরা

দশ বছর ধরে স্বর্ণ বিক্রির নিলাম বন্ধ

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দশ বছর ধরে স্বর্ণ বিক্রির নিলাম বন্ধ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দিন দিন স্বর্ণ চোরাচালান বাড়লেও গত ১০ বছর ধরে বিক্রির নিলাম হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণ ন্যায্যমূল্যে কিনতে চান ব্যবসায়ীরা। দেশের মানুষের স্বর্ণের চাহিদা পূরণে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বরাবর লেখা এক চিঠিতে এ অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজুসের এ প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ থাকলেও ব্যবসায়ীরা সে পথে হাঁটছেন না। তবে আপন জুয়েলার্সের ঘটনার পর থেকে ব্যবসায়ীরা অবৈধ (অপ্রদর্শিত) স্বর্ণের মজুদ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। এখন ওই আতঙ্ক দূর করার কৌশল হিসেবে বৈধ স্বর্ণের মজুদ বাড়াতে চাইছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আনার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নেয়ার বিষয়টি বৈষম্যমূলক ও কালক্ষেপণকারী প্রক্রিয়া। আমদানি নীতি আদেশ ২০০৯-১২ এর ২৫(২৩) উপঅনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৯৪৭ এর ধারা-৭ এর শর্ত পূরণ সাপেক্ষে স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ স্বর্ণ আমদানির অনুমোদন দিয়ে থাকে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ব্যাগেজ রুলসের আওতায় ১০০ গ্রাম স্বর্ণ বিনা শুল্কে এবং ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণবার বা স্বর্ণপি- প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রামে ৩ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে স্বর্ণ আনতে পারেন যাত্রীরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন, উচ্চ শুল্কসহ নানা জটিলতার অজুহাত তুলে ব্যবসায়ীরা বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে চোরাই পথে আসা স্বর্ণেই মিটছে দেশের সিংহভাগ চাহিদা। জানা গেছে, দেশে বছরে স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে কম- বেশি ৪০ টন এবং দেশে এর কোন খনি নেই। ফলে এ চাহিদার পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে পূরণ হওয়ার কথা। তবে প্রাপ্ততথ্য বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে আজ পর্যন্ত এক তোলা স্বর্ণও আমদানি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের স্বর্ণের বাজার মূলত চোরাচালাননির্ভর। প্রতিবছর চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগই চোরাচালান স্বর্ণের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। বাকিটা বাগেস রুলসের আওতায় আনা স্বর্ণের মাধ্যমে পূরণ হয়। সূত্র বলছে, প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আসছে। এর মধ্যে কিছু স্বর্ণ শুল্ক কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়ে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৯ বছরে ৪ হাজার ১৩০ কেজি অবৈধ স্বর্ণ আটক করা হয়েছে। জানা গেছে, অবৈধভাবে আসা স্বর্ণের চালান যেখানেই ধরা পড়–ক, তা জমা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। এক্ষেত্রে মালিকবিহীন অবস্থায় ধরা হলে সরাসরি তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী খাতে জমা হয়। আর মালিকানার দাবিদার থাকলে আদালতের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়। সূত্র মতে, স্বর্ণ চোরাচালান বাড়লেও গত ১০ বছর ধরে বিক্রির নিলাম হচ্ছে না। সর্বশেষ নিলাম হয় ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই, যেখানে ২১ কেজি ৮২২ গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, নিলাম একটি চলমান বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝেমধ্যেই বাজেয়াফত স্বর্ণ নিলাম করে এর অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা করে থাকে। তিনি বলেন, নিলামের সময় যে স্বর্ণগুলো আন্তর্জাতিকমানের (পাকা সোনা বা গোল্ডবার) সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে নেয়া হয়। আর যেটি আন্তর্জাতিক মানের নয় সেগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। বাজুসের চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, তারা যে চিঠি দিয়েছে, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বাজুসের চিঠিতে বলা হয়, জুয়েলারি একটি অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সঞ্চয়ের মাধ্যম হওয়ায় দেশে ও বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি স্বর্ণ সম্পূর্ণ একটি আমদানিনির্ভর কাঁচামাল হওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ অনুযায়ী এলসির সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরও এটি আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়, যা বৈষম্যমূলক এবং কালক্ষেপণকারী প্রক্রিয়া। বিষয়টির জটিলতার কারণে আমাদের জানা মতে, কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান অদ্যাবধি উল্লেখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বর্ণ আমদানি করেনি। এতে বলা হয়, সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় সংগৃহীত, মজুদকৃত, জব্দকৃত, বাজেয়াফতকৃত বিশাল স্বর্ণের মজুদ বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে, যা ২০০৮ সালের ২৩ জুলাইয়ের পর নিলাম ডাকা হয়নি। মূলত এই মজুদ কোন উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণে এ মজুদকৃত স্বর্ণ বৈধ জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করলে সরকার বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ পাবে। একই সঙ্গে বৈধ জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জটিলতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাই ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অতিসত্বর এসব মজুদ স্বর্ণ বিক্রির উদ্দেশ্যে নিলাম আহ্বান করার পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। এ বিষয়ে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, দীর্ঘ সময় স্বর্ণের নিলাম হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এদিকে দীর্ঘ ৪৫ বছরেও হয়নি স্বর্ণ আমদানির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। আর নীতিমালা না থাকায় এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এতে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে আপন জুয়েলার্সের ঘটনার পর এ খাতে নীতিমালা করার জোর দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে একটি যুগোপযোগী ‘জাতীয় স্বর্ণ নীতিমালা’ তৈরির ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে এ নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এটি চূড়ান্ত হবে বলে জানা গেছে। যদিও অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গেল ডিসেম্বরের মধ্যে এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে দলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, আমরা আশা করছি, শীঘ্রই এ খাতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা পাব।
×