ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাঙ্গা হচ্ছে চরের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

চাঙ্গা হচ্ছে চরের অর্থনীতি

সমুদ্র হক ॥ নদীর আয়তন কমে বাড়ছে চরের আয়তন। নিকট অতীতে চর ছিল শুধুই বালিয়াড়ি। গত ক’বছরে নদীর পলি এসে পড়ছে চরে। শাপে বর হয়ে চর ভূমি পরিণত হচ্ছে আবাদী ভূমিতে। বসতি গড়ছে মানুষ। যাদের বেশিরভাগ নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়া। চরের মাটিতে আবাদ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদনও বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে দানাদার শস্যের চাষ হচ্ছে বেশি। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে দিনে দিনে চাঙ্গা হয়ে উঠছে চরের অর্থনীতি। এক জরিপে বলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি চর পড়ছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তার শাখা নদীগুলোতে। এক সময়ে গঙ্গা অববাহিকার পদ্মায় চর পড়ত খুব কম। গেল এক যুগে পদ্মা নদীতেও চর পড়ছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মতই। বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় যমুনার তীরে গেলে মনে হবে এই নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এক চর থেকে আরেক চরে পৌঁছাত নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। বর্তমানে চরের সংখ্যা বেড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। চরের ওপর দিয়ে চলছে ঘোড়া গাড়ি, গরু ও মহিষের গাড়ি। কোন চর এককালীন চরগ্রামে পরিণত হওয়ায় সেখানে পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। বিদ্যুত পৌঁছায় কুটির শিল্প গড়ে উঠছে। নারী উন্নয়নসহ চরের মানুষের জীবন মানের উন্নতি হয়েছে। কী পরিমাণ চর জেগে উঠছে এর সঠিক পরিসংখ্যান মেলে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবের সঙ্গে মেলে না নদী ভূমি জরিপের হিসাব। চর জরিপও হয় বিচ্ছিন্নভাবে। এই জরিপের সঙ্গে চর দখলও হয়ে যায়। যা করে এলাকার প্রভাবশালী। চর জেগে ওঠার সঙ্গে প্রভাবশালীদের লাঠিয়ালরা গিয়ে দখলের খুঁটি গেঁড়ে আসে। তারপর চলে মৌখিক কথিত লিজ। চরে বাস করতে হলে ফসলের অংশ দিতে হয়। না দিলে বসতি খারিজ। বছর কয়েক আগে ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া নিয়ার ইস্ট রিভার চর ইন বাংলাদেশের এক জরিপে বলা হয় : নদীগুলো থেকে জেগে ওঠা চরের পরিমাণ অন্তত আড়াই হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে যমুনার চর এক হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। গঙ্গা ও পদ্মায় চর পড়েছে প্রায় ৭শ’ বর্গ কিলোমিটার। মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় চর পড়েছে ৪শ’ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। খালি চোখে চরগুলোর যে বেহাল অবস্থা দৃষ্টিতে আসে তাতে এই হিসাবের বাইরেও বেশি চর পড়ছে। পাউবোর মতে নদীগুলো ড্রেজিং না করায় উপচে পড়া বালি ও পলিতে চর জেগে উঠছে। নদী হারাচ্ছে নাব্য। বর্তমানে মোট ভূমির প্রায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ চরভূমি। দেশে উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে আছে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, গঙ্গা, সুরমা, কর্ণফুলী, তিস্তা, বুড়িগঙ্গা, আত্রাই, মহানন্দা, ধলেশ্বরী, গড়াই, মধুমতি, শীতলক্ষ্যা, ধরলা, হালদা, পুনর্ভবা, নাফ, বংশী, ইছামতি, সাংগু, মানু, নবগঙ্গা, পশুর, বাঙালী, খোয়াই, কংশ, ভৈরব, তিতাস, করতোয়া, তুরাগ, মুহুড়ি, ডাকাতিয়া, বাঁশখালি, চিত্রা, কালিগঙ্গা, চিকনাই, রূপসা, কীর্ত্তনখোলা, গুমতি লৌহজং ইত্যাদি। এখন মধ্যে এমন কোন নদী নেই যার কোথাও চর পড়েনি বা অংশ বিশেষ শুকিয়ে যায়নি। খোঁজ খবর করে এবং মাঠ পর্যায়ে ঘুরে জানা যায়, রাজশাহী থেকে চারঘাট হয়ে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত চর পড়েছে প্রায় আড়াই শ’। কুড়িগ্রাম থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত চর পড়েছে সবচেয়ে বেশি। যে সংখ্যা সাত শ’ ছাড়িয়ে যাবে। এইসব চরে পলি পড়ায় দানাদার শস্যসহ অনেক কিছুই আবাদ হচ্ছে। বগুড়া অঞ্চলের চরে সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে মরিচ, কাউন, বাদাম, তিল, মিষ্টি আলু, গম, ভুট্টা, পিঁয়াজ, রশুন, শশা ইত্যাদি। ইতোমধ্যে যমুনার চরের বাদাম ও মরিচের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বড় কনজুমার কোম্পানিগুলো যমুনার চরে ক্রয় কেন্দ্র খুলেছে। এতে চর অর্থনীতির সফলতা আসছে। এ দিকে বালিয়াড়ি চর পলির চরে পরিণত হওয়ায় বসতি গড়ে উঠছে। বাড়ছে জনঘনত্ব। একটা সময়ে চরে ঘাসও জন্মাত না। এখন পলির উর্বরতায় ঘাসসহ সকল ফসল ফলছে। উন্নত জাতের ঘাস জন্মানোয় চরে গরু-ছাগল পালন বেড়েছে। বিশেষ করে মিনি ডেইরি ফার্ম গড়ে ওঠায় গো দুগ্ধের চাহিদা মিটে প্রোটিন স্বল্পতা কমে যাচ্ছে। চরের ডেইরি ফার্মের দুধ উপজেলা পর্যায়ের হাট বাজারে বিক্রি হচ্ছে। একটা সময় চর বলতে মনে করা হতো কোন বসতি নেই। বর্তমানে চরগুলোর বড় একটি অংশ চরগ্রামে পরিণত হয়েছে। যেখানে জনবসতি, স্কুল, হাট বাজার, দাতব্য চিকিৎসালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চরের লোকসংখ্যা কত তারও সঠিক হিসেব নেই। তবে মনে করা হয় এই সংখ্যা অন্তত ১৫ লাখ।
×