ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কবির

বিদেহী আব্দুশ শাকুরের বৈদগ্ধ

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিদেহী আব্দুশ শাকুরের বৈদগ্ধ

দণ্ড প্রাপ্ত যক্ষ উজ্জয়িনী থেকে নির্বাসিত হয়েছিল রামগিরিতে। সেখানে সীতা-রামের যুগল পদচিহ্ন দেখে তার বিরহ বেদনা উথলিয়ে ওঠে। সেই উদগত বেদনার বাণী রূপ দিতে গিয়ে কবি কালিদাস ছন্দ গানে অপূর্ব অদ্ভুত ‘মেঘদূতম্’ রচনা করেছিলেন। কেননা, বেদনা যে সৃষ্টির সূতিকাগার। ১৯৮১ সালের সূচনায় রাজশাহী কলেজ থেকে পদোন্নতির নামে অনেকটা নির্বাসিত হয়ে সুন্দরবনের কাছের এক সদ্য সরকারীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেখানকার হালচাল দেখে মনে হয়েছিল কিসের শিক্ষা এবং শিক্ষকতাই বা কী? ওই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যাপক, আমার যোগদানের সময় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘রাজশাহী কলেজে আমরণ শিক্ষক থাকলেই গর্ব অনুভব করতাম’, অথচ এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়।’ সেই থেকে দুঃখে অভিমানে বইপত্রের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছিলাম। তাপদগ্ধ বেদনার চেতনা বাষ্পায়িত হয়েছে; কিন্তু কাগজ-কলম নিয়ে বসা হয়নি। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি অসাধারণ মেধাবী আব্দুশ শাকুর হঠাৎ করে চলে গেলেন। বলতে গেলে বিনা নোটিসে। শাকুর সাহেব এবং আমি একই সময়ে জগতের আলো দেখেছিলাম (১৯৪১)। তিনি বসন্তের ফুল ফোটানোর মেলায়, আর আমি তাপদগ্ধ বোশেখে। আমাদের লেখাপড়ার ধরনও একই পথের। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামেল, আমি বগুড়া থেকে জামাতে উলা। দুজনেই পথ পরিবর্তন করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। অসাধারণ মেধাবী শাকুর ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি দুর্বল মেধার মানুষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করলাম। যদিও দুজনেই মেধাবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী। ইংরেজী, বাংলা ছাড়াও আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় পা-িত্যপূর্ণ দক্ষতা ছিল আব্দুশ শাকুরের। শৈশবে পিতার কাছে শিখেছিলেন আরবী, ফার্সী ভাষা। ঘটনাক্রমে আমিও আমার পিতার কাছে আরবী, ফার্সী ভাষার প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। তিনি যেখানে কীর্তিমান, আমি সেখানে ম্লান, পা-ুর। অথচ আমাদের দুজনকে কূপম-ূপকতা স্পর্শ করতে পারেনি। আব্দুশ শাকুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে আসলেন ১৯৬৬ সালের নবেম্বরে এবং ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে গেলেন প্রশাসন সার্ভিসে। নোয়াখালীর রামেশ্বরপুরের মানুষ এসেছিলেন রাজশাহী। আমি তখনকার রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ পিএসসি-র মাধ্যমে নিয়োগপত্র পেয়ে গিয়েছিলাম নোয়াখালী সরকারী কলেজে। তিনি প্রশাসনের শেষ ধাপে উন্নীত হয়েছিলেন এবং কর্মরত অবস্থায় হল্যান্ডের আইএসএস থেকে অর্থনীতিতে এমএস- লাভ করেন। প্রশাসনে তিন দশকের সাফল্যের মাঝে সংস্কৃতির বিচিত্র অঙ্গনে তাঁর প্রতিভার বিস্ফোরণে আমরা সচকিত হতেই তিনি চলে গেলেন। একাধিক স্মরণীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন আব্দুশ শাকুর। সঙ্গীতের আনুষ্ঠানিক তালিম না নিয়েও বাংলা গানের ওপর তাঁর দখল ছিলো ঈর্ষণীয়। হারানো দিনের গান তিনি গেয়ে শোনাতেন সাবলীলভাবে। গানের ওপর তার লেখাও বাঙালীর রসতৃষ্ণাকে সজীব করেছে এবং সমৃদ্ধ করেছে জ্ঞান-ভা-ারকে। তাঁর রচিত ‘সঙ্গীত সংবিৎ’ যার সাক্ষ্য বহন করছে। বসরার ভুবন বিখ্যাত গোলাপকে রবীন্দ্রনাথ বাংলার রূপপিয়াসী মানুষের প্রিয় ফুলে রূপান্তর করেন। তাঁর অনেক গানে গোলাপের প্রসঙ্গ এসেছে। মহাপ্রয়াণের আগে তিনি কবিতায় গোলাপকে নভঃম-লে প্রোথিত করে গেছেন। সেই গোলাপ নিয়ে আব্দুশ শাকুর ‘গোলাপ সংগ্রহ’ নামে একখানা অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থখানি কেবল জ্ঞানগর্ভই নয় রসেরও আকর। আব্দুশ শাকুরের রচনায় আছে ব্যতিক্রমী চিন্তা। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে তাঁর ভাবনার দিগন্ত নানাভাবে প্রসারিত। রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনের গদ্য রচনাগুলোর মাঝে কবিতা-ছন্দের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কেন রবীন্দ্রনাথ অনন্য। এসব গদ্যে তিনি ড্রাইডেনের ভাষায় ‘আদার হারমনি অফ প্রোজ’ অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর অসামান্য রচনা ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ’। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রশান্তকুমার পাল উভয়েই রবীন্দ্রজীবন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তথ্যবহুল গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে রবীন্দ্রজীবন নাট্যের ও সৃষ্টিধারার শেষ অঙ্কের দৃশ্যগুলো বিস্তারিত রূপায়িত করে যেতে পারেননি। আব্দুশ শাকুর আমাকে বলেছিলেন, তিনি পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রজীবনী রচনা করে যাবেন। পরিতাপের বিষয়, মহাকালের অনন্ত সময়ের মাঝে তাঁর স্থিতি দীর্ঘায়িত হলো না। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত প্রথম ও দ্বিতীয় খ- রবীন্দ্রজীবনী রচনা করে তিনি ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩, অনন্ত নক্ষত্রলোকে যাত্রা করলেন। ‘গল্প সমগ্র’, ‘রম্য সমগ্র’, উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক-প্রবন্ধ ইত্যাদির প্রসঙ্গ উত্থাপন না করলেও সঙ্গীত, গোলাপ ও রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে তার রচনাত্রয়ী দীর্ঘদিন বাঙালীর পাঠক চিত্তকে রসের ধারায় সঞ্চিত রাখবে। আব্দুশ শাকুরকে স্মরণ করতে গিয়ে নিজের আকৃতার্থতা অবহিত হয়েও তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। শিষ্টাচারের বরখেলাপ জেনেও নিজেকে জড়ানোর কারণ হলো, ২০১১ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের রাজশাহী শাখার নিষ্ঠাবান সংগঠক তাপস মজুমদার আব্দুশ শাকুরকে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলাম অডিটরিয়ামে আকর্ষণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমি সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। লেখালেখির জগত থেকে আমার নিলিপ্ততা তাঁকে আহত করে। একদা প্রায় একই পথের পথিক ছিলাম বলে হয়ত তাঁর মনে হয়েছিল, লেখায় ফিরে এসে যেন নিজেকে সবল রাখি। নিজের অক্ষমতার জন্য প্রিয় বান্ধবের শুভ কামনা পূর্ণ করতে পারিনি। তবে অপটু কলমে কিঞ্চিৎ অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আজ জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের বাণী ধার করে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- হারিয়ে যাওয়া মনটি আমার/ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার। অথচ তিনি চলে /গেলেন, ‘অন্যকোথা, অন্য কোনোখানে।’ স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গতা দূর করেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের বিচিত্র গ্রন্থের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করে। প্রায় কথা হতো টেলিফোনে। তেমন গুরুতর কোন অসুখের কথা শুনিনি। তবে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রজীবনী রচনার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন প্রতিবারের আলাপনে। রবীন্দ্র অনুরাগীদের আকাক্সক্ষা পরিতৃপ্তির অলিখিত ভার নিয়েছিলেন তিনি। তা অপরিতৃপ্ত রয়ে গেল। তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। আব্দুশ শাকুরের আরদ্ধ কোন কাজ করার সামান্য সক্ষমতা আমার নেই। কেবল রবীন্দ্রনাথের বাণী দিয়ে উচ্চারণ করতে পারি- ‘স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি,/ভারমুক্ত সে এখানে নেই।’ লেখক : শিক্ষাবিদ
×