ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রায়ের বাজার বেড়িবাঁধে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রায়ের বাজার বেড়িবাঁধে  ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিশুরা নিষ্পাপ, ফুলের মতো সুন্দর। তারা ফুলের মতো ফুটবার এবং পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হওয়ার দাবি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। দেশের সম্পদের অসম বণ্টন ও সামাজিক অসঙ্গতির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অনেক শিশুর সুন্দররূপে বেড়ে ওঠা। তাদের সুন্দর হাতগুলো শিকার হচ্ছে শিশু শ্রমের। রায়ের বাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় স্টিল এবং লোহার কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায় কোমলমতি শিশুদের। যেখানে তাদের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকা দুটিই হচ্ছে চরম দারিদ্র্যতা ও বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে। রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের অলিউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে গ্রিলের কাজ করে সাইদ খান (১৩)। সে বলে, ‘বাবার রিক্সার আয় দিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে ৬ হাজার টাকা বেতনে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত কাজ করি। মা বাসাবাড়িতে কাজ করে। গ্রিল ঝালাইয়ের কাজে অনেক সময় চোখে শর্ট লাগে, হাত-পা কেটে যায়, তখন মালিক বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ দেয়া এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া আইনত নিষিদ্ধ তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে কমছে না শিশুশ্রম, যা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর। সাদেক খান তেলের পাম্পের পাশের ইটখোলার বস্তিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে জাকির হোসেন (১৩)। বেড়িবাঁধের জাহাঙ্গীর মিয়ার ওয়ার্কশপে ১৮০০ টাকা বেতনে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত লোহা টানার কাজ করে জাকির। জাকির বলে, ‘লোহা টানতে পারিনা কষ্ট হয়। বাবা রাজমিস্ত্রি, মা বাসাবাড়িতে কাজ করে, বড় ভাই বাসের হেল্পারি করে তাও বাড়িতে অভাব। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে, মা স্কুলে দিতে চায়, কিন্তু বাবা বলে স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই, কাজে যা। এই নিয়ে বাবা মায়ের খুব ঝগড়া হয়।’ বাংলাদেশের বাস্তবতায় নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় তাদের ঘরে চাঁদের টুকরা এলেও সে সন্তানটি হয় অবহেলিত, নিগৃহীত, অধিকারবঞ্ছিত। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তারা বেড়ে ওঠে পরগাছার মতো, মুখোমুখি হয় কঠিন বাস্তবতার। কেন শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করান জানতে চাইলে রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের ফাহিম এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা তো ওদের কাজ দিতে চাই না। ওদের বাবা মা এসে খুব অনুগ্রহ করে বলে, তখন বাধ্য হয়েই কাজ দিতে হয়। কাজে তো ঝুঁকি আছেই, কিন্তু এটাই আমাদের দেশের চিত্র।’ আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, যখন কোন শ্রম বা কর্ম পরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে তখন তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে। রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম সাগর বলেন, ‘বেড়িবাঁধের অনেক কারখানায় শিশুদের বড়দের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করায় কিন্তু বেতন দেয় অনেক কম। যে বেতন দিয়ে তারা চলতেই পারে না। বাবা যখন ছেলের কাজের জন্য এসে অনুরোধ করে, মালিকরা সেই সুযোগ নিয়ে ১ ঘণ্টার জায়গায় ২ ঘণ্টা কাজ করায়।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘জাতীয় শিশু জরিপ ২০১৩’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত আছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারী শিশু জরিপ ২০০৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের ৩.২ মিলিয়ন শিশু কাজ করে। যারা প্রতিনিয়তই হচ্ছে অধিকারবঞ্চিত। বেতন বৈষম্য থেকে শুরু করে তারা হয় নানারকম শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার। হায়দার স্টিল ওয়ার্কশপে লোহা টানার কাজ করে সামিম হোসেন (১২)। তিনি বলেন, ‘সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত মাসে ৩৫০০ টাকা বেতনে কাজ করি। বাবা মাকে ছেড়ে যাবার পর ভোলা থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আসার পর মা অসুস্থ হলে অনেক দিন ভিক্ষাও করছি। ঢাকায় মা আরেকটা বিয়ে করার পর থেকে আমি এই কারখানাতেই থাকি, লোহা টানি।’ বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক কারখানায় শিশুশ্রম, ট্যানারিশিল্প, যৌনকর্ম, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, পরিবহন খাত, ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করা, গ্যাস ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, অটোমোবাইল কারখানা, লবণ কারখানা, রিক্সা ও ভ্যান চালনা, কাঠমিস্ত্রির কাজ, জুয়েলারি শিল্পে কারিগরের কাজ, চাল ও মসলার কারখানায় কাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানার কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি। শিশু চিকিৎসক ডাঃ হাফিজুর রহমান বলেন, শিশুকাল শারীরিক ও মানসিক বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়। এমন সময় শিশুর পক্ষে উপযুক্ত নয় এমন কঠিন, বিপজ্জনক, ঝঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পরে তবে ওদের শারীরিক ও মানসিক গঠন বাধাগ্রস্ত হয়।
×