ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাঁচ সন্তানই সুশিক্ষিত

রত্নগর্ভা মা

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রত্নগর্ভা মা

সন্তানকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর হলেন মা। যে মায়ের সন্তানরা আজ প্রতিষ্ঠিত সেই মাকেই সমাজ সফল মা হিসেবে চিহ্নিত করেন। সমাজে সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার নিপুণ স্থপতি এবং সত্য ও সুন্দরের প্রতীক হিসেবে সফল মায়েদের উপাধি দেয়া হয় ‘রতœগর্ভা মা ’। সন্তানকে সত্যিকারের ও সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনকারী সফল একজন মা মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় গ্রামের (ঘরতাকিয়ার পূর্ব পাশের্) ফুলজাহান বেগম (৫৫)। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক স্বামীকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে ৫ সন্তানকে সুশিক্ষিত করে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। কাঁটাছড়া ইউনিয়নের পশ্চিম কাঁটাছড়া গ্রামের মরহুম এয়াকুব আলী মিস্ত্রি বাড়ির মরহুম জাকির হোসেন ও মুনহিয়া খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা ফুলজাহান বেগম ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিরসরাইয়ের শিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত সরকারী কমার্স কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নুরুজামান, অধ্যাপক আবুল কাশেম ও ব্যাংকার আবু তাহের ও প্রধান শিক্ষক আবুল বশরের ছোট বোন। প্রখর মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও নারী শিক্ষার পিছুটান ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় গ্রামের আবুল মুনাফ হাজী বাড়ির কৃষক মোঃ এনামুল হক মানিকের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। নানা প্রতিকূলতার কারণে নিজের স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও থেমে থাকেননি তিনি। নিজের লুক্কায়িত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নিজের সন্তানদের নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। এই নারী খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ৪ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানকে। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার জসীম উদ্দিন। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে এম এস ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এম.বি.এ করে বর্তমানে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। বড় পুত্রবধূ মাহবুবা মিশু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক রাজশাহী ব্রাঞ্চের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। উল্লেখ্য, মাহবুবা মিশু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ভাগ্নি। মেজো ছেলে মোঃ সাহাব উদ্দিন (চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম) জুড়িশিয়াল সার্ভিস কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে মাদারীপুরে জেলা জজ হিসেবে কর্মরত আছেন। মেজো পুত্রবধূ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। সেজো ছেলে ড. সেলিম ফখরুদ্দীন। ৯০ দশকের পর জোরারগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএস (ফার্মেসী) করে আমেরিকা সরকারের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে ফখরুদ্দীন আমেরিকার ড্রাগ ও ফুড প্রশাসনে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে মোঃ রেদোয়ান উদ্দিন রেজা এমএমএস (১ম শ্রেণী) এলএলবি, এলএলএম করে বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইনজীবী মুজিবুর রহমান চৌধুরী ও আইনজীবী আব্দুল মন্নানের সহযোগী হিসেবে নিয়োজিত আছেন। একমাত্র কন্যা সুলতানা রাজিয়া (¯œাতক) বর্তমানে গৃহিণী। স্বামী জোরারগঞ্জের দেওয়ানপুর গ্রামের মোঃ মমিনুল ইসলাম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সংসারে টানাপোড়েন, অর্থাভাবসহ নানা প্রতিকূলতার মাঝে কিভাবে ৫ সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জানতে চাইলে ফুলজাহান বেগম জানান, খুব অল্প বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সংসারে এসে নানা প্রতিকূলতা ও পারিপাশির্^ক অবস্থা দেখে খুবই চিন্তিত হতাম। কিন্তু কোনদিন হতাশ হইনি। স্বামী নিজেদের জমিতে কৃষি কাজের আয় দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার পরিচালনা করেছি। সন্তানদের সব সময় বুঝিয়েছি শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন করে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। লেখাপড়া হচ্ছে স্থায়ী সম্পদ। লেখাপড়া শিখে নিজে আলোকিত হয়ে সমাজকে আলোকিত করা যায়। অশ্রুসজল নয়নে এই মা বলেন, অনেক সময় ছেঁড়া কাপড় পরে, এক বেলা খেয়ে সন্তানদের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের খরচ জুগিয়েছি। এমনও দিন গেছে সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে কাটিয়েছে সারাদিন। তবুও শত কষ্ট টানাপড়েনের মাঝেও দীর্ঘ ১১ বছর সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক দিয়ে পড়েয়েছি। সেজন্য গৃহশিক্ষক মাওলানা সামসুল হুদার কাছেও আমরা ঋণী। সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কিভাবে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বড় ভাই সরকারী কমার্স কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নুরুজামানের অনুপ্রেরণায় এবং বাবার বাড়ির ভাই কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ফেরদৌস খান, নোয়াখালী দায়রা জেলা জজ মোর্শেদ, ইঞ্জিনিয়ার বাবু (বুয়েটে এম এস অধ্যয়নরত), ডা. পলাশের উৎসাহে সন্তানদের শিক্ষিত করার অনুপ্রেরণা পাই। সন্তানদের কাছে আপনার কী চাওয়া পাওয়া জানতে চাইলে ফুলজাহান বেগম জানান, আমি চাই সন্তানরা সমাজ ও দেশের কাজে এসে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকুক। নিজের আলোয় সমাজকে আলোকিত করুক। এছাড়া আমার সন্তান ও পুত্রবধূরা নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর নেন। তারা সবসময় ভাল থাকুক এই কামনা করি। ফুলজাহান বেগমের মতো এমন মহীয়সী নারী জন্মালে জন্ম নেবে এমন আলোকিত সন্তানরা। আর এই আলোকিত সন্তানরা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। স্যালুট জানাই ফুলজাহান বেগমের মতো রতœগর্ভা মায়েদের। তাঁর এই দৃষ্টান্ত অন্য মায়েদের অনুপ্রাণিত করবে যুগে যুগে। -রাজিব মজুমদার, মিরসরাই, চট্টগ্রাম
×