ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজপথে নামে বরিশালের নারীরা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাজপথে নামে বরিশালের নারীরা

“আমার প্রতিবাদের ভাষা আমার প্রতিরোধের আগুন জ্বলে দ্বিগুণ, প্রতিশোধে করে চূর্ণ ছিন্নভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল যেন”। ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকার জনসভায় ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার এ ঘোষণার পর বাঙালীরা প্রতিবাদ জানায়। ছাত্ররা গঠন করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।’ খাজা নাজিমউদ্দীনের ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশের ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বরিশাল। যে ভাষায় মা তার সন্তানকে গান গেয়ে ঘুম পড়ায়। যে ভাষায় মাঝি ভাটিয়ালী গান গেয়ে নৌকা চালায়। সে ভাষার অধিকার আদায়ে বরিশালবাসী প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রাম শুরু হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে এসে বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা করে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। সেমতে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক খানকে সভাপতি ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেমকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘বরিশাল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে বরিশালে ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ দিবস পালনের প্রস্তুতি চলে। বিক্ষোভে উত্তাল তখন গোটা বরিশাল। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্নেহময়ী মায়ের কণ্ঠ। মায়ের ঘুম পাড়ানি গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদী ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে। সেই শ্লোগানে শ্লোগানে রাস্তায় নেমে আসে বরিশালের নারী সমাজ। বরিশালের নারী ভাষা সৈনিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনÑ হামিদ উদ্দিন, রাণী ভট্টাচার্য, হোসনে আরা নিরু, মঞ্জু শ্রী সেন ও মাহে নূর বেগম। জেলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের আহ্বানে সেদিন সক্রিয় হয়ে ওঠেন এসব নারী ভাষা সৈনিকরা। ১৯৫১ সালে রাণী ভট্টাচার্য জগদীশ সারস্বত মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তখন যুদ্ধ করবার বয়স তার। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামের ডাক পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তখন ওই স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন প্রাণ কুমার সেন। তিনি ছিলেন জেলা সংগ্রাম কমিটির সদস্য। রাণী ভট্টাচার্য প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে কথা বললে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে বলেন। এমনকি প্রধানশিক্ষক তার মেয়ে মঞ্জু শ্রী সেনকেও আন্দোলনে নিয়ে যেতে বলেন। স্কুলের মেয়েদের সক্রিয় করতে হামিদ উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। রাণী ভট্টাচার্য, মঞ্জু শ্রী সেন ও হোসনে আরা নিরু, হামিদ উদ্দিনের সঙ্গে মেয়েদের সংগঠিত করতে থাকেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর মায়ের ভাষা নিয়ে পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে একদিন কেঁদে ফেলেন হামিদ উদ্দিন। পরবর্তীতে একদল ছাত্রী উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। রাজি হয় মিছিলে যেতে। কিন্তু পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু আর বুলেটের ভয়ে বয়স্করা তাদের নিষেধ করেন মিছিলে যেতে। কিন্তু স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু তাদের থামাতে পারেনি। কোন নিষেধই শুনলেন না তারা। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে মিছিলের উদ্দেশে নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে গেলেন তারা। জেলা নেতৃবৃন্দ নারী ভাষা সৈনিকদের মিছিলের সামনে দিয়ে সবার সঙ্গে শ্লোগান তোলেন ‘রাষ্ট্রভাষা-রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই-বাংলা চাই’। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় বরিশাল। সন্ধ্যায় খবর আসে ঢাকায় গুলি হয়েছে। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। ২২ ফেব্রুয়ারি অঘোষিত হরতালে বরিশালের দোকানপাট, স্কুল-কলেজ সব ছিল বন্ধ। বরিশাল পরিণত হয় প্রতিবাদ ও মিছিলের নগরী হিসেবে। সেদিন বর্তমান শহীদ মিনার মাঠ থেকে নগ্ন পায়ে শোক মিছিল বের করা হয়। মিছিলের সামনে ছিলেন হামিদ উদ্দিন, রাণী ভট্টাচার্য, মঞ্জু শ্রী সেন, হোসনে আরা নিরু, মাহেনুর বেগমের নেতৃত্বে শত শত নারী। ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন সময়ে বরিশালের মতো একটি মফস্বল শহরের নারীদের অবদানইবা কম কিসে? এদের ত্যাগেই মাকে আমরা মা বলে ডাকি ২১শে ফেব্রুয়ারি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গাই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।’ -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে
×