ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাষার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভাষার স্বপ্ন

কেয়া নন্দী ॥ স্কুলের পথে যেতে যেতে হঠাৎ অথৈ দাঁড়িয়ে পড়ল। মা ডাকছে। -অথৈ চলে এসো। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। অথৈ মাকে জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা মা, ওরা দেয়ালে কি লিখছে? -সামনেই তো ২১ ফেব্রুয়ারি। তাই ওসব লিখছে। মা উত্তর দিলেন। অথৈ স্কুলে গেল। কিন্তু এখনও তার মাথায় সেই দেয়ালে লেখা কবিতার লাইনগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। -শহীদ মিনার তো সামনে। তাহলে দেয়ালে কেন লিখছেÑ অথৈ ভাবতে লাগল। কিন্তু কবিতার লাইনগুলো খুব সুন্দর ছিল। সন্ধ্যায় অথৈ পড়তে বসেছে। বাংলা বইয়ে এ একটা কবিতা খুঁজে পেল। -হ্যাঁ। এই কবিতার লাইনগুলোও তো লেখা ছিল। ‘মোদের গরব মোদের আশা’ আ’মরি বাংলা ভাষা।’ অথৈ তার স্যারকে জিজ্ঞেস করছে- স্যার, ২১ ফেব্রুয়ারিতে কি হয়েছিল? ছোট্ট অথৈ জানে না ২১ ফেব্রুয়ারি কি? কেন এই দিনটি পালন করা হয়। কেন ফুল দেয়া হয়? -অনেক অনেক বছর আগে এই দিনটিতে এক বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল অথৈ। বলা হয়েছিল, আমরা আর বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারব না। আমাদেরকে অন্য ভাষা কথা বলতে হবে। আর তখন, এ দেশ বাংলাদেশ ছিল না। নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। অথৈ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে অনেক প্রশ্ন। -এটা তো আমাদের নিজের ভাষা। তাহলে কেন আমরা অন্য ভাষায় কথা বলব? -অথৈ জিজ্ঞেস করল। -সে জন্যই তো অথৈ। এই কারণে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ করল। তারা পথে পথে আন্দোলন করল। আর তখন পাকিস্তানের পুলিশ এই মানুষদের গুলি করল। অনেক মানুষ সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। আর তাঁদের এই ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাই। ফুল দিই। -আর জানো অথৈ, পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালীরাই ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে। রক্ত দিয়েছে। -স্যার বললেন। এবারই অথৈ স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুল থেকে বলেছে প্রভাত ফেরিতে যাবে। শহীদ মিনারে ফুল দিবে। অথৈও যাবে এবার। অথৈ বায়না ধরেছে শহীদ মিনার যাবে। কিন্তু মা দিতে চাইছে না। অথৈ তো এখনও খুব ছোট। মায়ের হাজার চিন্তা অথৈকে নিয়ে। একে তো ছোট। তার ওপর আবার খুব দুষ্ট। এত মানুষের ভিড়ে অথৈ যদি পড়ে যায় বা ব্যথা পায় কিংবা হারিয়ে যায়। মা অথৈকে যেতে দেবে না। কিন্তু অথৈও নাছোড়বান্দা। সে যাবেই। অবশেষে মা রাজি হলো। কিন্তু শর্ত আছে। মা নিয়ে যাবে তাকে। ফুল দিয়ে মায়ের সঙ্গেই আবার চলে আসতে হবে। অথৈ রাজি। সে প্রথমবার যাবে শহীদ মিনারে ফুল দিতে। কত কিছু ভাবছে অথৈ। আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে কত কষ্ট করতে হলো, কত মানুষ শহীদ হলো। ছোট্ট অথৈ এর চোখ ভিজে যায় জলে। পরের দিন বিকেলে বাবা অথৈকে নিয়ে গেল বইমেলায়। -বাবা, বইমেলা কেন হয়? -অথৈয়ের প্রশ্ন। -ফেব্রুয়ারি তো ভাষার মাস। বাংলা ভাষার প্রতি একরকম সম্মান জানাতেই এই বইমেলা করা হয়। -বাবা বলল। অথৈকে নিয়ে বাবা বিভিন্ন রকম বই দেখছে। অথৈ গল্পের বই পড়তে ভালবাসে। ও ঠিক পড়ে না। ওর মা ওকে পড়ে শোনায়। অথৈ কতগুলো বই কিনল। ছোটদের গল্পের বই। ঠাকুমার ঝুলি, তিন গোয়েন্দা আরও কত কি। সেদিন স্যার অথৈকে পড়াতে এসেছেন। অথৈ বইমেলা থেকে কেনা বইগুলো আনল স্যারকে দেখাতে। -এগুলো বাবা আমাকে কিনে দিয়েছে। বইমেলা থেকে। চারটা গল্পের বই!! -হুম, তুমি বইমেলায় গিয়েছিল তাহলে? - হ্যাঁ, স্যার। আমি আর বাবা গিয়েছিলাম। কত্ত কত্ত বই সেখানে! - দেখ তো, অথৈ এইটা তোমার পছন্দ হয় কি না? - কি এটা স্যার? - খুলে দেখ প্যাকেটে কি আছে? - অথৈ প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটা বই। বইয়ের নাম- ‘ছোটদের ২১ ফেব্রুয়ারি’। -এই বইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির গল্প আছে অথৈ। এটা তুমি পড়ো। এটা তোমার উপহার। -অথৈ খুব খুশি হলো। রাতে ঘুমানোর আগে অথৈকে গল্প পড়ে শোনায় মা। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ে ছোট্ট অথৈ। সে রাতে অথৈ স্যারের দেয়া বইটা নিয়ে এলো। মাকে বলছে- মা, আজ এই বইটা পড়ে শোনাও আমায়। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় কয়েকজন ভাষা শহীদের ছবি দেয়া। মা অথৈকে ডেকে বলল - দেখো অথৈ, এঁরা সকলেই ভাষা শহীদ। এই বাংলা ভাষার জন্য তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন। এই বলে তিনি বইটা পড়া শুরু করলেন। গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ অথৈ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ অথৈ দেখছে কে যেন তার হাত ধরল । অথৈ এর সামনে এসে বসল। - এই যে অথৈ কেমন আছো? - ভাল আছি। কিন্তু তুমি কে? অথৈ জিজ্ঞেস করল। - তুমি যাঁদের গল্প পড়ছ আমি তাঁদেরই একজন। তুমি তো আমাদেরই গল্প পড়ছ। - তুমি বাংলা ভাষাকে ভালবাসো? - হুম, অনেক ভালবাসি। -অথৈ বলল। - অথৈ তুমি তো অনেক ভাল গান গাইতে পারো। আমাকে একটা গান শোনাবে? - গান শুনবে তুমি? কোন গানটা গাই বলতো! - এই যে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি এই গানটা গাও।’ অথৈ গান গাইলো। - ওই দেখো অথৈ, ভোর হয়ে গেছে। তুমি যাবে না শহীদ মিনারে? অথৈয়ের ঘুম ভেঙে গেল। কোথায় যেন গান বাজছে। সেই গানটা। একুশে ফেব্রুয়ারির গান। মা অথৈকে ডাকছে। ভোর হয়ে গেছে। ওরা শহীদ মিনার যাবে। অথৈ তাড়াতাড়ি উঠে হাত মুখ ধুয়ে চলে এলো। সবাই এখনই যাবে। কিন্তু অথৈ কোথায়! তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অথৈ ছাদে গেছে। ওদের একটা বেশ বড়সড় গোলাপ গাছ আছে ছাদে। সেখান থেকে অথৈ সাতটা গোলাপ ফুল তুলে আনল। সেগুলোকে একটা ফিতা দিয়ে বেঁধে নিয়ে এলো। -ওই তো অথৈ। কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ- বাবা জিজ্ঞেস করল অথৈ ফুলগুলো দেখিয়ে বলল এগুলো আনতে গিয়েছিলাম। - ফুল তো এনেছি। আর কেন? ওখানেই তো অনেকগুলো ফুল ছিল । -= এগুলো তো আমার গাছের ফুল। আমার প্রিয় ফুল। আমি এগুলোই দিব শহীদ মিনারে- অথৈ বলল। - ঠিক আছে, দিও। এবার চল। আমাদের যেতে হবে অথৈ। এই বলে মা অথৈকে তৈরি করে দিল। এরপর অথৈ তার মা-বাবার সঙ্গে শহীদ মিনারে গেল। অনেক ভিড়। অনেক মানুষ এসেছে ফুল দিতে। সকলে প্রভাত ফেরি করে এসেছে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্য। অথৈ তার মায়ের সঙ্গে সামনে গিয়ে ফুল দিয়ে এলো। এত এত ফুলের ভিড়ে যেন অথৈ এর ফুলগুলো দেখাই যায় না। অথৈ এর মন খারাপ হয়ে গেল। অথৈ কাঁদছে। বাবা অথৈকে কোলে নিয়ে আদর করছে। - কি হয়েছে অথৈ? তুমি কাঁদছো কেন? -বাবা জিজ্ঞেস করল - আমার ফুলগুলো দেখা যায় না বাবা। - সবাই তো ফুল দিচ্ছে। তাই চাপা পড়ে গেছে। দেখা যায় না। কিন্তু দিয়েছ তো। তাতেই হলো। - বাবা, বিকেলে আমায় একবার নিয়ে আসবে এখানে? - কেন, এই তো এলে। আবার? - প্লিজ বাবা। বাবা আর না করতে পারল না। সামনেই তো শহীদ মিনার। কোন ব্যাপার নয়। নিয়ে আসা যাবে। - ঠিক আছে, নিয়ে আসব, - বাবা বলল। এবার অথৈ খুশি। বিকেলে সে আবার আসবে। তখন আবার ফুল নিয়ে আসবে। তখন তো দেখা যাবে। বিকেলে আর অথৈ ঘুমায়নি। সে বাবার সঙ্গে এখন শহীদ মিনারে যাবে। তার গাছ থেকে একটা গোলাপ তুলে নিল। তারপর চলল বাবার সঙ্গে। পড়ন্ত বিকেল তখন। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। অথৈ ফুলটা শহীদ মিনারে দিয়ে বাবার সঙ্গে সিঁড়িতে বসে আছে। - কি ভাবছো অথৈ? - বাবা জিজ্ঞেস করল।- জানো বাবা আমি আজ একটা স্বপ্ন দেখেছি। - কি স্বপ্ন অথৈ? - একজন লোক এসেছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি বাংলা ভাষাকে ভালবাসি কি না। আর বলল, একটা গান গাইতে। - তা কি গান গাইলে তুমি? - ওই যে একুশে ফেব্রুয়ারির গানটা, আজ সকালে যেই গানটা আমরা শুনেছি ওটা। -অথৈ উত্তর দিল। - খুব ভাল করেছ। এবার চল। আমরা বাসায় যাই। সেদিন আর স্যার পড়াতে আসেনি। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মা ঐ বইটা থেকে বাকি গল্পটা পড়ে শোনালেন। অথৈ ঘুমিয়ে পড়ল। সেই লোকটা আবার এসেছে। অথৈ এর হাত ধরেছে। - অথৈ, তোমার ফুলটা আমার খুব ভাল লেগেছে। অথৈ অবাক হয়ে লোকটাকে দেখছে। - তুমি এই বাংলা ভাষাকে অনেক ভালবাসো অথৈ। তা আমি বুঝতে পেরেছি। - হুম, আমি অনেক ভালবাসি তো এই ভাষাকে। - ভাষার স্বপ্ন অনেক বড় অথৈ। ভাষা তো চায় তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকতে। তোমাদের অনেক বড় স্বপ্ন দেখাতে চায় এই বাংলা ভাষা। ছোট্ট অথৈ তো একদিন অনেক বড় হবে। তখনও এভাবে ভালবাসে এই ভাষাকে? ২১ ফেব্রুয়ারিতে তোমার প্রিয় ফুল নিয়ে আসবে তো শহীদ মিনারে? - আসব। আমি শহীদ মিনারে আসব। আর অনেক অনেক ভালবাসব এই বাংলা ভাষাকে। আর তোমাকেও। - ভাল থেকো অথৈ। ভাল থাকুক তোমার স্বপ্নগুলো আর ভাষার স্বপ্ন এমন করেই বেড়ে উঠুক তোমার মধ্যে। ভাল থেকো অথৈ। বিদায়। -কোথায় যাচ্ছ তুমি? - অথৈ জিজ্ঞেস করল। - তুমি যদি এভাবেই ভালবাসো এই ভাষাকে তাহলে আমি আবার আসব অথৈ। এই বলে লোকটি চলে গেল। অথৈ এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতক্ষণ কি সে স্বপ্ন দেখছিল? হ্যাঁ, স্বপ্নই ছিল। ভাষার স্বপ্ন। ভাষাকে ভালবাসার স্বপ্ন। বাংলা ভাষার স্বপ্ন। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×