ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

সুরের আশ্রয়ে মর্মবাণীর আবাহনে সুফি উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সুরের আশ্রয়ে মর্মবাণীর আবাহনে সুফি উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ সুরের কাছে হারিয়ে যায় অশুর। সম্প্রীতির বার্তাবহ সঙ্গীতের স্নিগ্ধতায় ম্লান হয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা। অশুভ চেতনার পরাজয় হয় সঙ্গীতের সাতটি স্বরের কাছে। সুরের মরমী আহ্বানে ধর্মান্ধতার বেড়াজাল পেরিয়ে জেগে ওঠে মানবিকতা। সুরাশ্রিত মানবিকতার সেই মর্মবাণীকে ধারণ করে শুরু হলো দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সুফি উৎসব। ‘সম্প্রীতির জন্য সঙ্গীত’ প্রতিপাদ্যে তিনদিনের উৎসবটির সূচনা হয় শুক্রবার। আধ্যাত্ম্যবাদের উদ্ভাসিত সৌন্দর্যে বৈশ্বিক এ সঙ্গীতাসরে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান ও তুরস্ক। চার দেশের ১১৯জন সুফি ও লোকসঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গ পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছে পাঁচটি সঙ্গীতদল। সংস্কৃতিমন্ত্রী মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় যৌথভাবে উৎসবের আয়োজক আল্লামা রুমি সোসাইটি বাংলাদেশ ও হাটখোলা ফাউন্ডেশন। উৎসবের প্রথম দিনে সুফি গানে মরমী বাণীতে শ্রোতার অন্তরে প্রশান্তি ছড়িয়ে মাইজভা-ারি মরমী গোষ্ঠী, পারভেজ, শফি ম-ল, সামির কাওয়াল ও রাফাত । বসন্ত বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত আঙ্গিনায় উৎসবের উদ্বোধন হয়। প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকাস্থ ইরানের রাষ্ট্রদূত আব্বাস ভায়েজি দেহনবি ও তুরস্কের রাষ্ট্রদূত দেভরিম ওজতুর্ক। সংস্কৃতি সচিব মোঃ ইব্রাহীম হোসেন খানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও আল্লামা রুমি সোসাইটির সভাপতি মোঃ আব্দুল করিম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন হাটখোলা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মুহাম্মেদ। মৌলবাদকে রুখে দিতে সুফিবাদের গুরুত্ব তুলে ধরে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সুফিবাদ হচ্ছে মানবতা চিন্তার প্রতিফলন। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতি ও সহাবস্থনের মর্মবাণীকে ধারণ করে সুফিবাদ। তাই অশুভ শক্তিকে দমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সুফিবাদ। হাজার বছর ধরে এই বাংলায় বাউল, মুর্শিদী গানের মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছে মানবতার মর্মবাণী। সঙ্গীতের এই ধারাটি সকল ধর্মের সহাবস্থানের কথা বলে। সম্প্রীতির ভাবনাই এখানে মূল কথা। এই ভাবধারায় সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাঁই নেই। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, এখানে সব ধর্মের মানুষ রয়েছে; একইসঙ্গে রয়েছে নানান ভাষা ও সংস্কৃতি । তাই সম্প্রীতির আশ্রয়েই এগিয়েছে এই বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি। ফকির লালন সাঁই, রাধারমন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম-গানে গানে ছড়িয়েছেন সেই মানবতার বাণী। ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীও শান্তির বার্তাবহ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ইসলামের নামে যারা হলি আর্টিজানের মতো হামলার ঘটনা ঘটায় তারা আসলে অমানুষ। আব্বাস ভায়েজি দেহনবি বলেন, ধর্মীয় মর্মবাণীর চর্চা প্রত্যেক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই মর্মবাণীর অপব্যাখ্যা হলে সেটা সব ধর্মের জন্যই হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। তখনই সৃষ্টি হয় ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর। এর বিপরীতে সুফিবাদ শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রত্যেক ধর্মের মূল বিষয় হচ্ছে যদি কেউ সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসে তবে সে একই ভালবাসবে মানুষকে। সেই ভালবাসার বাণীকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিই করে সুফিবাদ। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, সুফিবাদের মূল কথাটি হচ্ছে ভালকে গ্রহণ করা ও মন্দকে পরিহার করা। লালন ফকিরের মতো সাধকরা সেই মর্মবাণীকে গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। ডেভরিম ওজতুর্ক বলেন, সুফিবাদের চর্চা বিশ্বব্যাপী ইসলামের নামে সংঘাতের পথ বন্ধ করতে পারে। আবদুল করিম বলেন, বাংলাদেশের ৮৫ভাগ মানুষ মুসলিম হলেও তারা হাজার বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে উঠেছে। তারা হিজাব পরলেও ভোটের সময় দুইজন নারীকেই বেছে নেয়। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় শ্রোতার চৈতন্যে কড়া নাড়া সুফি সঙ্গীতের আসর। প্রথমেই সুফি গান নিয়ে মঞ্চে নয় সদস্যের মাইজভা-ারী মরমোষ্ঠী। কোরাস কণ্ঠে তারা গেয়ে শোনায় ‘দমে দমে জপরে মন’। এই দলের বাবুল শীল গেয়েছেন ‘হায়রে আশেকের ভা-ারী’। নয়নশীলের কণ্ঠে গীত হয় ‘কত খেলা জানরে মওলা’। ‘দেখে যাও মাইজভা-ারে’ শিরোনামের গান শুনিয়েছেন আবু তালুকদার হাবিব। সৈয়দ আদিল মাহবুব আকবরী গেয়েছেন ‘এহেন নিদানের কালে’। সব শেষে সম্মেলক কণ্ঠে দলটি পরিবেশন করে ‘মওলা তুইরে তুই’। উৎসবের সূচনা রাতে সমীর কাওয়ালের পরিবেশনাটিও ছিল শ্রোতার জন্য দারুণ উপভোগ্য। এই শিল্পী গেয়ে শোনান ‘আল্লাহু আল্লাহু’, ‘চলরে চল কাফেলা বেধে মক্কা মদিনায়’, ‘আমার দেহ মন বলে নবী নবী’ ও ‘আলী আলী মওলা আলী’ শিরোনামের একগুচ্ছ গান। এরপর একে একে সুফি সঙ্গীত পরিবেশন করেন শফি মন্ডল, রাফাত ও পারভেজ। প্রথম দিনের শেষে পরিবেশনাটি উপস্থাপন করে ভারতীয় সঙ্গীতদল সুফি বাওরা। রবিবার পর্যন্ত চলবে এ উৎসব। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত দশটা অবধি চলবে এই সঙ্গীতাসর। আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে বেলা ৩টায় থাকবে সুফি বিষয়ক সেমিনার। এ দিন সঙ্গীত পরিবেশন করবেন পুলক, শিরিন ও রাজ্জাক, কিরণ চন্দ্র রায় ও চন্দনা মজুমদার এবং টুনটুন বাউল ও হানিফ বাউল। এ দিনের বিদেশী দল হিসেবে পরিবেশনা উপস্থাপন করবে তুর্কি সুফি দল। শনিবার উৎসবের সমাপনী সন্ধ্যায় আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করবেন শিল্পী হায়দার, হারুণ, ইকবাল হায়দার, দীপংকর, সুনিল কারাকার, সিরাজ বাউল, জলের গান, ইরানি সুফি দল ও ভারতের রুহানি সিস্টার্স। চারুকলার বকুলতায় গম্ভীরা উৎসব ॥ একে অপরের সংলাপে ফুটে উঠছে দেশের হারানো ঐতিহ্য রেশম শিল্পের কথা। এ শিল্পকে পুনরুদ্ধারে মরিয়া এই শ্রমিকের দল। তাদের সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করেছে গ্রামের আপামর জনগণ। কখনও গানে আবার সংলাপে কখনও রম্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করছে তাদের অভিপ্রায়ের কথা। এমন দৃশ্যপটে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় গম্ভীরা উৎসবের সূচনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুল তলায় দ্বিতীয়বারের মতো এ উৎসবের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন দিয়াড়। দুই দিনব্যাপী উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত পশুপতি মোক্তার, সোলেমান মোক্তার, মোবারক হোসেন ও বীরেণ ঘোষের স্মৃতির প্রতি। সংগঠনের সভাপতি মুখলেসুর রহমান মুকুলের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির। জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। পরে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সদস্যসচিব আনোয়ার হক। এরপর শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সুজাতুল আলম কল্লোল, রোজিনা আক্তার রিতা, মোঃ কামাল উদ্দীন ও কবি আপেল আবদুল্লাহ। বক্তরা বলেন, গম্ভীরা বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম একটি ধারা। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়। বক্তরা গম্ভীরাকে লোকসঙ্গীতের স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান। আলোচনার পর শুরু হয় গম্ভীরা পরিবেশনা। শুরুতে রেশম শিল্পের পুনরুদ্ধারে করণীয় বিষয় নিয়ে গম্ভীরা পরিবেশন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দল। এরপর একে একে গম্ভীরা পরিবেশন করে লোকগম্ভীরা, সঙ্গিতা, নবাব ও রসকস গম্ভীরা দল। প্রত্যেক দলের পরিবেশনা শেষে তাদের ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সব শেষে সমাপনী বক্তব্য রাখেন সভাপতি মুখলেসুর রহমান মুকুল। আজ শনিবার বিকেল ৪টায় শুরু হবে উৎসবের শেষ দিনের আয়োজন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন চারুকলার ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, সাংসদ মোঃ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, বরেণ্য শিল্পী অধ্যাপক রফিকুন নবী প্রমুখ। আলোচনার পর গম্ভীরা পরিবেশন করবে প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চাঁপাই নকশী, ভোলাহাট, আদি গম্ভীরা ও সূর্য দিগন্ত গম্ভীরা দল।
×