ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এবার মশার আক্রমণে মালয়েশিয়াগামী ফ্লাইট বিলম্বিত

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এবার মশার আক্রমণে মালয়েশিয়াগামী ফ্লাইট বিলম্বিত

আজাদ সুলায়মান ॥ দীর্ঘদিন পাখির আক্রমণ থেকে মোটামুটি নিরাপদে ছিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তাতে পাইলটরা কিছুদিন শান্তিতে থাকলেও এবার বেঁকে বসেছে মশা। পাখির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মশারাও যেন একযোগে আক্রমণে নেমেছে। যে কারণে বৃহস্পতিবার রাতে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বের শিকার হয়। এ ঘটনায় তোলপাড় দেখা দেয়। কারণ সাধারণত পাখির আঘাতের কারণে বিমান আটকে যাওয়ার ঘটনা আছে অনেক। কিন্তু মশার কারণে ফ্লাইট বিলম্বÑ বিশ্বে হয়ত প্রথম ঘটনা এটি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বৃহস্পতিবার রাতে এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার পথে ফ্লাইটটি উড্ডয়নের সিডিউল ছিল। কিন্তু তাতে বিপত্তি ঘটায় মশা। সংঘবদ্ধ মশার আক্রমণের দরুন দুই ঘণ্টায়ও উড়তে পারেনি সেটি। পরে রাত ২টা ৪৬ মিনিটের দিকে ওই উড়োজাহাজ রওনা দিতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, বিমানবন্দরে আলফা-২ বে এরিয়া থেকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের (এমএইচ ১৯৭) ফ্লাইটটি যাত্রীদের নিয়ে উড্ডয়নের জন্য রানওয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিমানবন্দর থেকে বোয়িং ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজে ১৫০ জন যাত্রী ওঠার সময় মশাও ঢুকে পড়ে। মশার উৎপাতে যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে অভিযোগ করেন কেবিন ক্রুদের কাছে। বাধ্য হয়ে রানওয়ের পরিবর্তে পুনরায় বে এরিয়ায় উড়োজাহাজটি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন বৈমানিক। এরপর মশা নিধন চলে প্রায় দুই ঘণ্টা। রাত পৌনে ৩টার দিকে পুনরায় ফ্লাইটটি ছেড়ে যায়। এ ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন এয়ারলাইন্সটির কর্মীরা। অন্য এয়ারলাইন্সগুলোকেও মশার কারণে বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে বলে জানা যায়। ওই ফ্লাইটের যাত্রী কেয়া জানান, মাঝরাতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইটে অসংখ্য মশা ঢুকে পড়ায় যাত্রীরা চেঁচামেচি ও হট্টগোল শুরু করেন। মশার উৎপাতে রাত দেড়টায় চলন্ত ফ্লাইটটিকে রানওয়ের মুখে থামিয়ে দিতে বাধ্য হন পাইলট। পরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রায় এক ঘণ্টা চলে মশক নিধন অভিযান। এ সময় যাত্রীদের সবাইকে বিমান থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। তিনি জানান- শাহজালালের রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এই ঘটনা ঘটে। বিমানের ভেতরে অসংখ্য মশা ঢুকে পড়ায় যাত্রীরা চেঁচামেচি ও হট্টগোল শুরু করেন। এক ঘণ্টার মধ্যে বিমানের ভেতর ও রানওয়েতে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষ। পরে রাত পৌনে ৩টার দিকে ফ্লাইটটি আকাশে ওড়ে। বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী জানান-মশার উৎপাতের কারণে ফ্লাইট আটকে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বে এটিই হয়ত প্রথম। তবে শাহজালালে মশার উৎপাত নতুন নয়। ফ্লাইটে ওঠার পর যাত্রীরা মশার কামড়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রায়ই। বিদেশীরাও বিরক্তি প্রকাশ করে থাকেন। বিমানবন্দরের ভেতরে-বাইরে তো কথাই নেই। লাগেজ বেল্টে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে মশার কামড়। বিমানবন্দরের দুরবস্থার কথা স্বীকার করে আক্ষেপের সঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, এমন ঘটনায় দেশের মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। কিন্তু চেষ্টা করেও মশার কাছে আমাদের হার মানতে হচ্ছে। জানতে চাইলে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ আজিজ বলেছেনÑ মশার কারণে আমাদের ফ্লাইটটি যথাসময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি। বে এরিয়া থেকে যাত্রী ওঠানোর সময় উড়োজাহাজে মশা ঢুকে পড়ে। যাত্রীরা মশার উৎপাতে বিরক্ত হয়ে যান। বাধ্য হয়ে মশা নিধন করে পুনরায় ফ্লাইটটি ছেড়ে যায়। তিনি বলেন-তখন রাতে বিমানবন্দরে যারা দায়িত্বরত ছিলেন তাদের কাছে ফ্লাইট বিলম্বের তথ্য জানিয়েছি। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তারা ছিলেন না। বিষয়টি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছেও জানাব। তারপর দেখা যাক কি হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা। সঙ্গে রয়েছে দুপাশের জঙ্গল ও জলাশয় যা- মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র। এ বিশাল ও উন্মুক্ত এলাকার মশা নিধন করাটা খুবই কঠিন কাজ। তারপরও এ বিষয়টি খুব সিরিয়াসলি দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মশা নিধনের বিষয়ে জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে মশানিধনের বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব উদ্যোগে মাত্র দুটো ফগার দিয়ে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় স্প্রে ছিটানো হয় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। যন্ত্রপাতি ও জনবলের ঘাটতি থাকায় আন্তরিক চেষ্টা থাকলেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মশা নিধন কি আসলেই অসম্ভব বিষয় কিনা জানতে চাইলে দেশের শীর্ষ পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি হিটম্যান পেস্ট কন্ট্রোল, বিডির কর্ণধার শহীদ উল্লাহ পাটওয়ারী বলেন, যেহেতু শাহজালালের চারপাশে ঘন জনবসতি, জলাশয় ও জঙ্গল রয়েছে, সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুটা জটিল ও কষ্টসাধ্য বিষয়। তবে এটা অসম্ভব নয়। বিপুলসংখ্যক জনবল ও প্রয়োজনীয় জনবল যদি সার্বক্ষণিক স্প্রে ও অন্যান্য প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তাহলে সেটা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটা সিভিল এভিয়েশনের পক্ষে দুরূহ হতে পারে-কিন্তু হিটম্যানের অভিজ্ঞ ও শীর্ষ কোম্পানিগুলোর পক্ষেই কেবল এটা সম্ভব। এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আয়তন বিশাল ও বিস্তৃত। সে তুলনায় জনবল ও যন্ত্রপাতি সিভিল এভিয়েশনের নেই। কিন্তু সেজন্য মশা মাছি পোকামাকড় ইঁদুর ও তেলাপোকার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যদিও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ঠিক এই মুহূর্তেই সিভিল এভিয়েশনের পক্ষে পুরোপুরি পেস্ট কন্ট্রোলের কাজ করানো সম্ভব নয়। এটা আউট সোর্সিং করলেও দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। সেজন্য আপাতত জরুরী ভিত্তিতে যেটা সম্ভব সেটা হলো শাহজালাল বিমানবন্দরের পাবলিক স্পেস যেমন ভিআইপি-ভিআইপি, কনকর্স, ক্যানপী, ওয়েটিং এরিয়া, গ্রিন চ্যানেল, ইমিগ্রেশন, বোডিং এরিয়া, বে এরিয়া এয়ার সাইট, নামাজের স্থান ও টয়লেট এলাকা সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্বে করানো যেতে পারে। আর বিমানবন্দরের যেসব প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট ব্যবহার করা হচেছ বা ইজারা দেয়া হয়েছে- সেগুলো যেমন-দোকানপাট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অভিজাত লাউঞ্জ ও বিভিন্ন অফিসগুলো ভাল কোন কোম্পানি দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্বে তাদেরই করতে হবে। এভাবে সরকারী-বেসরকারী সম্মিলিত উদ্যোগে এ সমস্যা খুব দ্রুত সময়েই করা সম্ভব। এজন্য শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি দিক নির্দেশনাই যথেষ্ট। এছাড়া আপাতত আর কোন সহজ উপায় দেখা যাচ্ছে না।
×