ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কাজলরেখা নদী দখল

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কাজলরেখা নদী দখল

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ দখল হয়ে যাচ্ছে কাজলরেখা নদী! টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আলদীবাজার কাছে প্রাচীর তৈরি করে বালু দিয়ে কাজলরেখা নদী দখল করেছে প্রভাবশালী মহল। বাজারের মসজিদে মুসল্লিদের যাতায়াতে রাস্তা নির্মাণের অজুহাতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নদীর তীর দখল কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। আর নদীর তীর দখলের খবর পেয়ে উর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে স্থানীয় তহশীলদার সরেজমিন পরিদর্শনের পর দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে সত্যতা নিশ্চিত হয় টঙ্গীবাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়। এরপরই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাবিরুল ইসলাম খাঁন ভরাট কাজে জড়িত ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বেপারীকে নির্দেশ দিয়ে তীর দখলের কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে ইউপি চেয়ারম্যান সমর্থিত কতিপয় মুসল্লি কার্যালয়ে গিয়ে মসজিদের রাস্তার জন্য তীর দখলের অনুমতি চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাদের জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ার কথা বললেও সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে কোন অনুমতি দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল শেষে পরবর্তীতে কাঁঠাদিয়া শিমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা খোঁজখবর ও তদারকি না করার সুযোগে প্রভাবশালী মহলটি প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই বালু দিয়ে তীর দখল করে ফেলেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী কাজলরেখা নদীটি এখন প্রস্থে ছোট খালে পরিণত হয়ে গেছে। ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে নেপথ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী প্রতিবাদ করতেও সাহস পায়নি। এমনকী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ থাকায় তদন্ত প্রতিবেদন ফাইলবন্দী অবস্থায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ফলে জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানার নেতৃত্বে ‘সবুজে সাজাই মুন্সীগঞ্জ’ স্লোগানে দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল পুনরুদ্ধার কর্মসূচী বাধাগ্রস্ত করার অপরাধের শামিল বলে স্থানীয় এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনে করছেন। কাঁঠাদিয়া শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দাবি, আলদীবাজারের মসজিদের রাস্তার জন্য নদীর তীরের কিছু অংশ ভরাট করা হয়েছে। যাতে মুসল্লিরা যাতায়াত করতে পারে। আর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেছে, মসজিদের রাস্তা নির্মাণের কথা বলে ১৫ ফুট প্রস্থ ও ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে বিপুল পরিমাণের জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করায় কাজলরেখা নদী ছোট খালে পরিণত হয়ে গেছে। মুন্সীগঞ্জ সড়ক ও জনপথ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আলদীবাজারে কাজলরেখা নদীর ওপর থাকা বেইলিব্রিজ ভেঙ্গে সেখানে পাকা সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের পর ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত যান ও মানুষের চলাচলের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আর এই বিকল্প সড়কটি হবে উত্তর ও দক্ষিণমুখী। ঠিকাদারের লোকজন পূর্ব ও পশ্চিমমুখী খুঁটি গেঁথে নদীর তীর ভরাট করার বিষয়টি তাদের জানা নেই। এমনকী দরপত্রে উল্লেখ বা কর্তৃপক্ষের কোন নির্দেশনাও নেই।স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানায়, উপজেলার আলদীবাজার বেইলিব্রিজ ভেঙ্গে সেখানে আরসিসি পিলারে নতুন সেতু নির্মাণে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। তাই বেইলিব্রিজটি ভেঙ্গে তার পাশেই নদীর ওপর দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করে ঠিকাদার। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বিকল্প সড়ক নির্মাণের জন্য কাঁঠাদিয়া শিমুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বেপারীকে সাব-ঠিকাদার নিযুক্ত করলে এ সুযোগে বিকল্প ব্রিজ নির্মাণের পাশাপাশি মসজিদের রাস্তার অজুহাতে কাজলরেখা নদীর তীরও ভরাট করে ফেলে ইউপি চেয়ারম্যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, উত্তর ও দক্ষিণমুখী সেতু হওয়ায় বিকল্প সড়ক নির্মাণও একইমুখী করা হয়েছে। কিন্তু সাব-ঠিকাদার বিকল্প সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি কাজলরেখা নদীর তীরের পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রস্থে ১৫ ফুট ও দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুট এলাকা পর্যন্ত খুঁটি গেঁথে বালু ফেলে ভরাট করে ফেলেছে। উপজেলা আ’লীগের এক নেতা জানান, মসজিদ নির্মাণ স্থানে যাতায়াতে রাস্তার প্রয়োজন হলেও প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে নদীর তীর দখলের কোন সিদ্ধান্ত নেই মসজিদ কমিটির। তাই মসজিদের রাস্তার নামে নদীর তীরে যে পরিমাণ জায়গা দখল হচ্ছে, তা মূলত অসৎ উদ্দেশেই করা হচ্ছে। স্থানীয় গ্রামবাসী জানায়, নদীর তীর ভরাট করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হলেও সেই নিয়মকে অমান্য করেই সাব-ঠিকাদারসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বালুর বস্তা ফেলে ভরাট কাজ করেছে প্রকাশ্যেই। স্থানীয় এক আইনজীবী জানান, তীরের বিপুল পরিমাণের জায়গা দখলে নিয়ে বালু দিয়ে ভরাট কাজ করায় কাজলরেখা নদীটি ছোট খালে পরিণত হয়ে গেছে। এমনিতেই বছরের পর বছর পলি জমে নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নৌযান চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে দখল উৎসবের কারণে বর্ষা মৌসুমে নৌযান চলাচলে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, বালু ফেলে নদীর তীর দখলের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। একদিকে বিকল্প বেইলিব্রিজ নির্মাণ করছে শ্রমিকরা অন্যদিকে বালু ফেলে কাজলরেখা নদীর তীরের বিপুল পরিমাণ জায়গা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান ভরাট কাজের স্থানেই অবস্থান করছিলেন। এ প্রসঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন বেপারী বলেন, নদীর তীরে পশ্চিম-দক্ষিণে আলদীবাজারের মসজিদ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। মসজিদের মুসল্লিদের যাতায়াতে রাস্তা নির্মাণ ও অন্যান্য সুবিধার জন্য তীরের কিছু অংশ ভরাট করা হয়েছে। যাতে ১০ ফুট প্রস্থে রাস্তা করা যায়। প্রশাসনের অনুমতি নেয়া হয়েছে কী না জানতে চাইলে কোন সুদুত্তর দিতে পারেনি ইউপি চেয়ারম্যান। টঙ্গীবাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, সড়ক ও জনপথের আবেদনের প্রেক্ষিতে আলদীবাজার বেইলিব্রিজ ভেঙ্গে নতুন আরসিসি পিলারে ব্রিজ নির্মাণ কাজের জন্য জনস্বার্থে সাময়িক বিকল্প সড়ক নির্মাণের অনুমতি দিলেও তার পরিবর্তে বালু ফেলে নদীর তীর দখল করার অনুমতি দেয়ার কোন বিধান নেই সরকারী নির্দেশনায়। তাই তীর দখলের অভিযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন তহশীলদারদের সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
×