ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

সংস্কৃৃতির বিশ্বায়নে মাতৃভাষার মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সংস্কৃৃতির বিশ্বায়নে মাতৃভাষার মর্যাদা

আন্তর্জাতিক পরিম-লে জাতিগত সীমান্ত রেখাগুলো অতিক্রম করে অবাধ পণ্য, সেবা ও তথ্যের প্রবহমান অভিযাত্রাকে সাম্প্রতিককালে বিশ্বায়ন নামে সংজ্ঞায়িত করা হলেও এই বিশ্বায়ন ভাবনা নতুন কোন বিষয় নয়। এর উৎপত্তি ১৬ শতাব্দীতে উপনিবেশীকরণের যুগ থেকেই বিস্তৃত। জনাব ওয়াহিদুল হকের মতে ‘প্রাচীন বিশ্বে দাস প্রথার যুগে দূর বাণিজ্যের রূপে বিশ্বায়নের সূচনা ঘটেছিল। সামন্তবাদের যুগে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পরে ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণকালে বিশ্বায়ন পরিগ্রহ করে উপনিবেশবাদের রূপ, যার অর্থনৈতিক প্রকাশ ছিল বণিকতন্ত্র’ (সূত্র : হাসানুজ্জামান চৌধুরী : বিশ্বায়ন- বিস্তার ও বিরোধ, ২০০৬)। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী প্রকাশিত মানব উন্নয়ন রিপোর্টে বিশ্বায়নকে একটি বর্ণনা এবং একই সঙ্গে একটি ব্যবস্থাপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্যবস্থাপত্র হিসেবে জাতীয় ও বৈশ্বিক ম-লে বাণিজ্য উদারীকরণ, অর্থায়ন ও তথ্যের মুক্তপ্রবাহ প্রবৃদ্ধি, যা মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণাকৃত। স্ট্রিটেন ১৯৯৮ সালে এই বিশ্বায়নের ফলে লাভবানের তালিকায় বিত্তবান মানুষ, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ, শিক্ষিত, পেশাজীবী, ব্যবস্থাপক ও কৃৎকৌশলী, পুঁজি, ঋণদাতাগোষ্ঠী, বৃহৎ খামার, বৈশ্বিক সংস্কৃতি, বৈশ্বিক এলিট এবং ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় কর্মসংস্থান, বিত্তহীন মানুষ, মজুরি, নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ, অশিক্ষিত, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ, ঋণগ্রহীতা, ক্ষুদ্র খামার, স্থানীয় সংস্কৃতি ও দারিদ্র্য ইত্যাকার বিষয়কে তালিকাভুক্ত করেছেন। এটি সর্বজনবিদিত যে, বাংলার অধিকতর উর্বরতার ফসলের ভিত্তিতে অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকর করার লক্ষ্যেই এ অঞ্চলে বিভিন্ন পর্যটক, বণিক ও লুম্পেনলুটেরা শক্তির আগমন ঘটে। সতেরো শতকের এই বাংলা সম্পর্কে ফরাসী ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস বার্নিয়ার বলেছিলেন, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মনোরম ও সুফলা দেশ হিসেবে মিসরকে বর্ণিত করা হলেও বিষয়টি আসলে প্রাপ্য ছিল এই বাংলার। বিদেশী বণিকদের আকৃষ্ট করার মতো এত বিচিত্র ও মূল্যবান পণ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে এই বাংলার অবস্থান ছিল অতুলনীয়। ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ও ভারত ভাগের পর পাকিস্তান নামক সামরিক এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষের জন্যে দ্রোহ ও আলো প্রজ্বালনের সূচনাপাঠ। এর ধারাবাহিকতায় একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চূড়ান্তভাবে সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। অতঃপর প্রচন্ড এক রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়। ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে হাজার বছরের বহু আগে। ইংরেজী, ফরাসী বা জার্মান ভাষার মতো বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রায় দশম শতক থেকেই ঐতিহ্যম-িত। মূলত মানব সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান সৃষ্টির পটভূমিতে রয়েছে অবস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই ধ্যান-ধারণা। অবস্তুগত সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ মাতৃভাষা মানুষের মনোজগতের ভাব-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা, সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যাকার সকল অপার্থিব ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত। যেহেতু অন্য কোন প্রাণীর ভাষা নেই, তাদের সংস্কৃতিও নেই। একমাত্র ভাষার কারণে মানুষ সংস্কৃতিমনা হতে পেরেছে। বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মতে এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী ভাষা হচ্ছে বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নবজাগৃতির সূচনা করেছে। বাঙালী জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিশাল আত্মত্যাগের মহিমা বাঙালী জাতির জন্য শুধু গৌরবগাথা নয়, এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ব আজ গৌরবদীপ্তও হয়েছে। খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশকালকে যদি চিহ্নিত করা হয় তাহলে এই ভাষার সমৃদ্ধির ইতিহাস প্রায় চৌদ্দ শ’ বছর। বাঙালী জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে এই মাতৃভাষার অবদান শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিম-িত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই ভাষার অবদান এক অসাধারণ চেতনায় বৈশিষ্ট্যম-িত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একুশের চেতনায় ভাস্মর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিসমূহ তথা সংবিধানসম্মত জাতিসত্তার প্রধান চার স্তম্ভ- জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ মূল্যায়ন না করে এবং সর্বত্র এর বিকাশমানতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনভাবেই জাতির সামষ্টিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল স্তরে এবং সকল জনপদে শিক্ষাকে যদি কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায় তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন নিয়ামকসমূহের তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা তা যে শুধু ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান শাসিত অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সম্প্রসারিত হয়েছিল তা নয়, এর বহু আগে থেকে বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে স্বশাসনে প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আবদুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণি’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন- ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণি, সে সব কাহার জনম নির্ণয়ন জানি’। এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গার্থক কথপোকথন বা কোন রচনার পঙ্ক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল এই অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালী জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের অবিনাশী প্রকাশ। ‘আমার ধ্যানের ভারত’ শীর্ষক রচনায় ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) বলেছেন- ‘মাতৃভাষাকে স্থানচ্যুত করার পদ্ধতিকে ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় বলে বর্ণনা করা যেতে পারে’। তিনি বলেন, রামমোহন রায় আরও বড় সংস্কারক এবং লোকমান্য তিলক আরও বড় প-িত হতে পারতেন যদি তারা তাদের চিন্তাধারাকে ইংরেজীতে প্রকাশ না করে মাতৃভাষায় প্রকাশ ঘটাতেন। অবশ্যই উল্লেখ্য, গুণী ব্যক্তিরা ইংরেজী সাহিত্যের সুসমৃদ্ধ রতœভা-ারের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে না হওয়াতে এ জ্ঞান অর্জন কতটুকু জনগণের উপকারে এসেছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। নিজের মাতৃভাষায় জ্ঞানের সমৃদ্ধিকরণকে অবহেলা করে গান্ধী মনে করেন, একদল অনুবাদকের সৃষ্টি করে কোন জাতি মহৎ কিছু অর্জন করতে পারে না। মাতৃভাষায় চিন্তা, মত প্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জনের যে ধারা সেটি বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশসমূহ তথা চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান ইত্যাদির উন্নয়নের সফল ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা অভিষিক্ত হলেও এখনও আমরা পাই যে, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় একটি রিট আবেদন করা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না, বাংলা ভাষা আইন সর্বত্র অনুসরণ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং ঐ আইনের ৪ ধারা অনুসারে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করার নির্দেশ দেয়া হবে না, এই মর্মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সাতজনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রুল চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ইংরেজীতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নম্বর প্লেট, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লেখার অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য কলেজ, মুদ্রা, স্ট্যাম্প এবং নৌবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষাসহ সরকারী সকল কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেমন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়েছিল, উল্লিখিত রিট আবেদন নতুন করে সেই চেতনাকে শাণিত করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। ‘একুশ মানেই মাথা নত না করা’। মাতৃভাষা আন্দোলনের এই অপ্রতিরোধ্য চেতনার ধারা এখন কতটুকু জোরালোভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে, এই রিট আবেদন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির অপরিসীম উন্নয়ন মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এবং এর যথাযথ মর্যাদা ও সর্বক্ষেত্রেই এর সামগ্রিক প্রচলন যতটুকু না প্রভাব বিস্তারের কথা ছিল, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলেই আমাদের এখনও আদালতের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাঙালী জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে! সংস্কৃতির বিশ্বায়ন আমাদের এমন এক ভঙ্গুর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মোড়কে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে, যা প্রতিনিয়ত আমাদের ঐতিহ্যকে নষ্টামির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। উল্লিখিত উপলব্ধি থেকেইে হয়ত মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমি আমার ঘরটিকে চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত ও আমার জানালাগুলো বন্ধ রাখতে চাই না। আমি চাই সকল দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরের চারপাশে যত ইচ্ছা স্বাধীনভাবে এসে ভিড় করুক। কিন্তু তার কোনটি আমাকে স্থানচ্যুত করবে সেটি আমি হতে দেব না।’ জাতিসংঘ ঘোষিত বর্ণনায় উঠে এসেছে- স্থান, কাল ও সীমান্তের সঙ্কোচন থেকে একটি বৈশ্বিক গ্রাম সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকের পক্ষে এর নাগরিক হওয়া সম্ভব হয় না। বিশ্বায়ন কিছু মানুষের জন্য অভূতপূর্ব মানবিক অগ্রগতির সুযোগসমূহ প্রসারিত করে, কিন্তু অন্যদের জন্য সেসব সুযোগ সঙ্কুচিত করে দেয় এবং মানব নিরাপত্তার অবক্ষয় ঘটায়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের ধারণা অনুযায়ী প্রচলিত নব্য উদারনৈতিক বিশ্বায়নের মতাদর্শ গণমাধ্যম, জনসংযোগ শিল্প ও বিজ্ঞাপনের সাহায্যে তথা সংবাদ বুলেটিন, সাক্ষাতকার, সম্পাদকীয়, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনযন্ত্র এমন এক স্থান দখল করেছে, যাতে সাধারণ নাগরিকেরা পরিণত হয়েছে পণ্যসামগ্রীর উৎসাহী ভোক্তা ও ক্রেতায়। অধ্যাপক জ্যাকি বি. জেলিনাসের মতে- এই বিজ্ঞাপন কর্মযজ্ঞে প্রতি বছর কোম্পানিগুলো খরচ করে ১৪০০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি যা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মোট ঋণের ৭০ শতাংশ বা বিশ্বব্যাপী শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সকল সরকারী ব্যয়ের ৫০ শতাংশ। সংস্কৃতির এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জাতিগত ঐতিহ্যিক অনুশীলন, ভাষার গুণগত চর্চা ইত্যাদি বাংলা ভাষাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। ‘বাঙলিশ’ অর্থাৎ বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে সংবাদ পরিবেশন, বিনোদন কর্মকান্ড উপস্থাপন, বিজ্ঞাপনযন্ত্রে অতিমাত্রায় অনর্থক প্রযুক্তির ব্যবহার, আবৃত্তি, নৃত্যকলা, নাটক, ছায়াছবি ইত্যাদিতে এমন এক অপসংস্কৃতির ধারার বিকাশ ঘটাচ্ছে; টেলিভিশন ও বেতারনির্ভর এসব কর্মকা- কোনভাবেই যে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি উন্নত জাতির ভবিষ্যতকে সত্য-সুন্দর কল্যাণ এবং আনন্দের পথে এগুতে দেবে না, এটি অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×