ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাদারীপুরে এক পরিবারের ৩ জন বিরল রোগে আক্রান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মাদারীপুরে এক পরিবারের ৩ জন বিরল রোগে আক্রান্ত

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ চোখের সামনেই সন্তানদের মৃত্যুর পথযাত্রা ভেবে দরিদ্রতার কাছে মা-বাবার অসহায় আত্মসমর্পন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিজমা সর্বস্ব বিক্রি করেছে একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে। কিন্তু বিধাতা যেখানে নীরব সেখানে যৎসামান্য সেই চেষ্টা কোন কাজে তো লাগেইনি বরং ধীরে ধীরে মেনে নিতে হচ্ছে প্রিয় সন্তানদের মৃত্যু পথযাত্রা। এমনই এক নির্মম বাস্তবতার মুখে বিরল রোগে আক্রান্ত জেলার রাজৈরের রাজ্জাক শেখের পরিবার। বিরল রোগে আক্রান্ত একমাত্র ছেলে আব্বাসের একটি পা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে হয়েছে হাতির পায়ের সমান। শরীর জুড়ে আঁচিলের পাহাড়। ২৪ বছর ধরে বড় মেয়ে বিছানায় প্রতিবন্ধী। আর বোন ৪০ বছরের প্রতিবন্ধী জীবন কাটাচ্ছে জরাজীর্ণ বিছানায়। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজৈর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের আলমদস্তার গ্রামের রং মিস্ত্রী আঃ রাজ্জাক শেখের ৩ সন্তান ও বোন জন্ম প্রতিবন্ধী। ৪০ বছর বয়সী বোন ইসমত-আরা শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। এই ৪০ বছর ধরেই বিছানায় জীবনযাপন তার। ২৪ বছর বয়সী বড় মেয়ে শারমিন আক্তারের একই দশা। সেও বিছানায় শুয়ে কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন। ১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়ে আদুরী আক্তার প্রতিবন্ধী জীবন কাটিয়ে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ৩ বছর আগে। ১৩ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আব্বাস শেখ জন্মের পর ডান পা মোটা ছাড়া প্রায় স্বাভাবিক ছিল। বংশের প্রদীপ নিভে যাওয়ার আশঙ্কায় মোটা পায়ের চিকিৎসা করাতে শুরু থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করে মা-বাবা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের নামী-দামী সকল হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কিন্তু উন্নতির পরিবর্তে দিনদিন অবনতি হয়ে ডান পা ফুলে হাতির পায়ের সমান হয়ে গেছে। নির্গত হচ্ছে এক ধরনের রস। ছেলেটির সারা শরীর জুড়েই হয়েছে ছোট বড় হাজারও আঁচিল সদৃশ। বয়সের চেয়ে শারীরিক গঠন ছোট। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা সবই গেছে। আছে শুধু বাড়িটুকু। তাই পরিবারটির প্রিয় সন্তানসহ সদস্যদের মৃত্যু পথযাত্রা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। প্রতিবেশী হালিমা শেখ বলেন, ‘এই পরিবারের তিন ভাই-বোন ও তাদের এক ফুফু শারিরিক প্রতিবন্ধী হয়েই জন্ম নেয়। এক বোন চিকিৎসার অভাবে ৩ বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাসের যে কী রোগ হয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। ওর চিকিৎসার জন্য ওর বাবা অনেক টাকা খরচ করতে গিয়ে জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব।’ আরেক প্রতিবেশী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ছোট্ট আব্বাসের ডান পা ফুলে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মতো হয়েছে। শরীরে দুর্গন্ধ শুরু হয়েছে। আগে ছেলেটি স্কুলে গেলেও এখন আর যেতে পারছে না। ওর সুচিকিৎসা দেয়া এই গরিব পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী আব্বাসকে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করুক।’ আব্বাসের বাবা রাজ্জাক শেখ বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে জন্ম থেকেই হাঁটতে পারে না। এক বোনেরও একই অবস্থা। বিছানায় রেখেই ওদের লালন পালন করছি। তার মধ্যে ছোট মেয়েটি চিকিৎসার অভাবে প্রায় তিন বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাস জন্মের সময় ডান পা তুলনামূলক মোটা ছিল। কিন্তু দিন দিন আব্বাসের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পা ফুলে হাতির পায়ের মতো মোটা হয়ে গেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মতো হচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কোন পরিবর্তন হয় নাই। জমিজমা সব গেছে। এখন পরিবারের সবার খাবার জোটানোই আমার পক্ষে কষ্ট হচ্ছে চিকিৎসা করাব কীভাবে।’ আব্বাসের মা আল্পনা বেগম বলেন, ‘ঘরে তিনটি মানুষ মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমার স্বামী রং মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। ওদের চিকিৎসার জন্য জমিজমা বিক্রি করেছি। অনেক টাকা ধারকর্জ করেছি। এহন এই বাড়িটুকুই আছে। আমরা এহন কী করুম জানি না। সরকার যদি আমাগো সাহায্য করতো তাইলে আমাগো একমাত্র ছেলে আব্বাস মনে হয় সুস্থ হইয়া যাইতো।’ বিরল রোগে আক্রান্ত আব্বাস শেখ বলেন, ‘আমার পা দিন দিন ফুলে মোটা হচ্ছে আর সারা শরীরে গোটা গোটা হচ্ছে। আবার পা থেকে দুর্গন্ধ রস বের হচ্ছে। তাই স্কুলেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার অনেক ইচ্ছা হয় লেখাপড়া করার। অন্য সবার মতো খেলাধুলা করার। কিন্তু আমার দিন দিন যে অবস্থা হচ্ছে জানি না কী হবে।
×