ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত দাবি

কানাইখালী নদী খননের নামে অর্থ লুটপাট

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কানাইখালী নদী খননের নামে অর্থ লুটপাট

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ, ২২ ফেব্রুয়ারি ॥ পাগনার হাওড়ের পানি নিষ্কাশিত হয় যে নদী দিয়ে তার নাম কানাইখালী নদী। জামালগঞ্জের দুঃখ খ্যাত এ নদী খননের নামে সরকারী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠছে। এই হাওড়ের বেশির ভাগ জমি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় অনাবাদি রয়েছে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর বোরো জমি গত ২০ বছর যাবত। পলিতে ভরাটকৃত এই নদী খননের নামে বার বার সরকারী বরাদ্দ দিয়ে লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও হাওড়ের জলাবদ্ধতা নিরসন না হওয়ায় স্থানীয় কৃষকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিএডিসি, হিলিপ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কানাইখালী নদী এলাকায় খনন কাজ করলেও তা হাওড়ের জলাবদ্ধতা নিরসনের কোন কাজে আসেনি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি উল্লেখ করে স্থানীয়রা জানালেন, হয়েছে যৌথ যোগসাজশের লুটপাট। সম্প্রতি পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হেসেন মঞ্জু পাগনার হাওড়ের জলাবদ্ধতার অবস্থা সরেজমিনে দেখে এই হাওড়ে যাদের জমি রয়েছে সেই সব কৃষকদের কথা শুনেছেন। তারা মন্ত্রীকে বলেন, বছরের পর বছর ফসলবঞ্চিত থেকে থেকে বিত্তসম্পন্ন অবস্থা থেকে অনেকেই দরিদ্র অবস্থায় পতিত হয়েছেন। মন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, নদী ও খাল খননের মাধ্যমে অচিরেই এই সমস্যার সমাধান করা হবে এবং সরকার তার অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্যই পাগনার হাওড়ের জমিকে আবারও চাষাবাদের আওতায় আনা হবে। জানা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সুনামগঞ্জ জোনের দাবি কানাইখালী নদী সংশ্লিøষ্ট গজারিয়া খালের ভরাটকৃত অংশের ৩ কিলোমিটার ৭০০ মিটার অংশ খনন করেছিল। বিএডিসি এখানে প্রতি কিলোমিটারে খনন ব্যয় দেখিয়েছে ১২ লাখ টাকা। দরপত্রের মাধ্যমে ভরাটকৃত নদীর ৬/৭ ফুট গভীর করে নদীর উপরিভাবে ৪০ ফুট প্রস্থ ও নদীর তলদেশে ১২ ফুট প্রস্থ করে খনন কাজ হয়েছিল দাবি করে বিএডিসি সুনামগঞ্জ জোনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, দেড় কিলোমিটার করে তিন কিলোমিটার খাল করেছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও-এর নামালংগাইর’র ‘মেসার্স হালিমা এন্টারপ্রাইজ’ ও ঢাকা মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের ১৯/৪ এর ‘মেসার্স দি সিমেন্টেশন’ নামের দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে অবশিষ্ট ৭০০ মিটার খাল কোন প্রতিষ্ঠান খনন করেছিল তার কোন তথ্য দিতে পারেনি এই কর্তৃপক্ষ। এ দিকে চলতি বোরো মওসুমে ওই কানাইখালী নদী খননে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন দিয়েছে। ওই বরাদ্দে ভরাটকৃত নদী প্রতি কিলোমিটার ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে খনন করা হবে। নদীর তলদেশে ৭ ফুট, ওপরে ২৫ ফুট ও ৫ ফুট গভীর করে খনন করা হবে বলে জানিয়েছেন পাউবোর কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সালে এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান হিলিপ ৩৫ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫০ টাকা ব্যয়ে এই নদীর ৩ কিলোমিটার জায়গা খননের কাজ করেছিল। তবে কানাইনখালী নদী সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অভিযোগ পাউবো, বিএডিসি ও হিলিপ প্রকল্প লোক দেখানো কাজ করেছে। তাদের কাজে কৃষকদের কাক্সিক্ষত উপকার হয়নি। তবে ওই বরাদ্দ সম্পর্কেও জানেন না এলাকার কৃষকসহ স্থানীয় লোকজন। কীভাবে ওই বরাদ্দের কাজ হচ্ছে তাও অবগত নয় উপকারভোগী কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ বার বার নদী ও খাল খনন করা হলেও তাতে কৃষকদের কোন উপকার হয়নি। খননের নামে শুধু লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং সরকারী অর্থ লোপাট হয়েছে। নদীর কোন অংশই সঠিকভাবে খনন করেনি। কোথায় কতটুকু খনন করা হয়েছে তা জানেন না তারা উল্লেখ করে উপকারভোগী কৃষকরা বললেন, সঠিকভাবে কানাইখালী নদী খনন হলে এর সুফল পাবেন ফেনারবাঁক, ভীমখালী ও জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ২০-৩০টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক। কৃষকদের অন্তত ৭ হাজার হেক্টর বোরো জমি আবারও চাষাবাদ করা যাবে। গজারিয়া বাজারের ব্যবসায়ী কামধরপুর গ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন,‘ কানাইখালী নদী খননে কত টাকা বরাদ্দ হয়, কাজের পরিমাণ কত থাকে, কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তার কিছুই তারা জানেন না। গত বছর গজারিয়া স্লুইসগেট এলাকার খালে বিএডিসি তিন-সাড়ে তিনফুট গভীর করে ও ৭/৮ ফুট প্রস্থ করে এই সাইটে কিলোমিটার খানেক খনন করেছিল। আমি দুইদিন খনন এলাকা ঘুরে দেখেছি, এর বেশি খনন হয়নি। গজারিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহাব উদ্দিন বলেন, বিএডিসি খননের অর্ধেক কাজও করেনি। যতটুকু খনন করেছে, তার মাটি অপরিকল্পিতভাবে খালের তীরে রাখায় সেই মাটি আবারও খালেই পড়েছে। যার কারণে হাওড়ের পানি নিষ্কাশনে আরও সমস্যা হয়েছে। চলতি বোরো মওসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্রমিক দিয়ে এই খাল খনন করেছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের এই দূরত্বই মূলত যাবতীয় দুর্নীতির উৎস হিসেবে কাজ করে। দুর্নীতিবাজরা চায় না, স্থানীয় কেউ উন্নয়ন কাজে নাক গলাক। অথচ সকল উন্নয়ন কাজে এমন জনতদারকি তথা সামাজিক নীরিক্ষা ব্যবস্থা চালুর প্রয়েজনীয়তার প্রসঙ্গ এনে, স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী আখতারুজ্জামান বলেন,‘যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয়েছে তা দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করলে কৃষকদের দুর্ভোগ থাকত না। প্রকৃতপক্ষে হাওড়ের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন কাজ হয়নি। এই দুই প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিক তদন্ত হলে থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে। কানাইখালী নদী ও তৎসংলগ্ন খালে খনন কাজ পরিচালনার বিষয়টি একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা এবং একই সঙ্গে সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় পাগনার হাওড়ের জলাবদ্ধতা দূর করতে যথাযথ খনন কাজ অবিলম্বে শুরু করার দাবি করে স্থানীয় কৃষক নেতা জুলফিকার চৌধুরী রানা বলেন,‘ কৃষকদের মারা-বাঁচার সমস্যা কানাইখালী নদী ও গজারিয়া খাল। এই নদী ও খাল খননের নামে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প শুধু লোক দেখানোভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং বরাদ্দ আত্মসাত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিএডিসি জামালগঞ্জ ইউনিটের উপসহকারী প্রকৌশলী মোঃ হাসান মাহমুদ বলেন,‘যারা আমাদের খনন কাজ নিয়ে অভিযোগ করছেন তারা না জেনেই বলছেন। বিএডিসি খারাপ কোন কাজ করে না। আমরা গজারিয়া স্লুইসগেটের প্রায় ৬০-৭০ ফুট দূর থেকে হাওড়ের মুখে একটি অংশের ৩ কিলোমিটার ৭০০ মিটার খাল খনন করেছি। অন্য আরেকটি অংশে আরও তিন কিলোমিটার খনন করার কথা ছিল। কিন্তু পানি চলে আসায় তা সম্ভব হয়নি। হিলিপের প্রকল্পের জামালগঞ্জের স্থানীয় এলসিএস (চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদল) সংগঠক রোকন মিয়া বলেন,‘ আমরা কর্তৃপক্ষের করা ডিজাইন ও প্রাক্কলন অনুযায়ী কানাইখালী নদীর খনন কাজ করেছি। ডিজাইনেই স্লেøাপ কিছুটা কম ছিল। তবে প্রাক্কলনের ছেয়ে বেশি করে মাটি খনন করেছি। আমাদের কাজে কোন অনিয়ম হয়নি।’ পাগনার হাওড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাউবোর শাখা কর্মকর্তা (এসও) নিহার রঞ্জন দাস বলেন, পাগনার হাওড়ের উজানের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য জরুরী ভিত্তিতে কাজ করার জন্য মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল। এক লোক গজারিয়া খালে কিছু কাজ করেছে। এখন হাওড়ের দিকে শ্রমিক দিয়ে নদী খননের চেষ্টা চলছে।
×