ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বকীয়তা রক্ষা করতে হবে

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘গৌরবোদীপ্ত অবদানের’ স্বীকৃতি হিসেবে ২১ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। বর্তমানে চলছে বিশ্বায়নের যুগ। দ্রুতগতি ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তির রমরমা। এর সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে প্রতিটি দেশ ও জাতিকে। যে বা যারা পারছে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে। আর যারা পারছে না, পিছিয়ে পড়ছে তারা। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে এদিক থেকে পিছিয়ে পড়লে কিংবা পিছিয়ে থাকলে চলবে না। তবে আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই মোটেও। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট খুব শীঘ্রই উৎক্ষেপিত হতে যাচ্ছে মহাকাশে। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। নিজস্ব অর্থায়নে ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি বহু উচ্চারিত নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তদুপরি বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-চারুকলা-কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বাংলা ভাষা বর্তমানে সারা বিশ্বে স্বীকৃত অষ্টম ভাষা, যে ভাষায় ২৫ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে ও লিখে থাকে। বাঙালীর ভাষার অধিকার আদায়ের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালীর আত্মত্যাগের দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় ও হচ্ছে। এতে প্রতিটি দেশ ও জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষাসহ নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি-স্বকীয়তা সুরক্ষিত হচ্ছে দিন দিন। অথচ ইউনেস্কো বলছে, প্রতি ১৪ দিনে বিশ্ব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীর সেই স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশ ও ভারত একই দিনে পালন করছে দিবসটি। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বলা যায়, মূলত পহেলা ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও প্রকৃতপক্ষে ২১তম দিনটি বইমেলার শ্রেষ্ঠতম দিন। কেননা, এদিন মধ্যরাতের প্রায় প্রথম প্রহর থেকেই জনসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, সুবিশাল ও মহিমাম-িত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ চত্বরে, সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতার আলোকস্তম্ভের আশপাশে। এ সময়ে বই কেনার হিড়িকও পড়ে যায় সব বয়সীর মাঝে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভাল ও উদ্দীপনাদায়ক উদ্যোগ। দেশের প্রকাশক ম-লী, লেখক সম্প্রদায় সর্বোপরি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রায় উন্মুখ হয়ে থাকেন গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটির জন্য। স্বভাবতই বইয়ের বেচাকেনাও বেড়ে যায় বহুগুণ। তবে কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে অনিবার্য। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে মানসম্মত ও পাঠোপযোগী কয়টি? এমনকি যে একুশে ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গর্ব করি এবং যেটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত, সে সম্পর্কেও। ভাল বইয়ের অভাব প্রকট। এত দৈন্য, এত অপ্রতুলতা কেন? প্রকাশকরা বলছেন, এ বিষয়ে ভাল গবেষণা ও পা-ুলিপির অভাব প্রকট। আজকাল লেখকরাও কেন যেন পাঠকপ্রিয় ও চটুল বই লেখতে সমধিক আগ্রহী। সিরিয়াস বই লেখালেখিতে তরুণদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। তা কেন হবে? তরুণ প্রজন্ম যদি ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ-কাল-কৃষ্টি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক না জানে, তাহলে সমৃদ্ধ ও স্বশিক্ষিত হবে কিভাবে? শুধু মোবাইল, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকে আসক্ত হলে তো একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বিজ্ঞান ও মননে যথার্থ অর্থে আধুনিক ও শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে বহু প্রত্যাশিত বইমেলা তরুণ প্রজন্মের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছে না। অমর একুশে ও ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুসাহিত্যসহ সৃজনশীল লেখনী শিল্প ও প্রকাশনা শিল্পের সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে দেশে, যার অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি ও পরিধি কম নয়। এখন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অবশ্য কর্তব্য হবে একে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক পরিম-লে মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। উদাহরণত বলা যায়, বইমেলায় বিষয়-বৈচিত্র্যের প্রকট অভাব লক্ষ্য করা যায়। অথচ সারা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কতই না এগিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেও এই চর্চা বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ব। প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত বক্তব্যে সে কথারই প্রতিফলন ঘটেছে।
×