ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কম খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা

দূরদূরান্তের অসচ্ছল রোগীদের ক্যান্সার চিকিৎসায় সহায়তা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দূরদূরান্তের অসচ্ছল রোগীদের ক্যান্সার চিকিৎসায় সহায়তা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বছর তিনেক আগে জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় আসেন যশোরের ডলি বেগম (৪০)। ডাক্তার দেখান মহাখালীর ক্যান্সার হাসপাতালে। ক্যান্সারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু রাজধানীতে থাকার জন্য কোন আত্মীয় স্বজন নেই। থাকবেন কোথায়? খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কারণ বাসা ভাড়া করে থাকা বা হোটেলে থেকে চিকিৎসা করানোর সাধ্য তার নেই। একপর্যায়ে ভাবেন, হয়তো আর চিকিৎসা করানো হবে না। কিন্তু এরই মধ্যে সন্ধান মেলে দিগন্ত ক্যান্সার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের। নামমাত্র টাকায় থাকা খাওয়া হাসপাতালে আসা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। সেই থেকে এখনও চলছে তার চিকিৎসা। ডলি বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, যখন কেমো থেরাপি দেয়ার প্রয়োজন হয় তখন আমি ঢাকায় এসে দিগন্ত ফাউন্ডেশনে আশ্রয় নেই। শেষ হলে আবার বাড়ি চলে যাই। রেডিও থেরাপি দেয়ার জন্য এসে থেকেছি। মোট কথা, এই তিনবছর ধরে আমার চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে যতবার ঢাকায় এসে থেকেছি আমি দিগন্ত ফাউন্ডেশনে থেকেছি। এই জায়গাটা না পেলে হয়তো আমার চিকিৎসা করানো হতো না! গত ১৬ জানুয়ারি জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন কনিকা চৌধুরী (৩২)। তিনি এসে দিগন্ত ফাউন্ডেশনের খোঁজ পেয়ে সেখানে ওঠেন। ওই দিন থেকে এখনও দিগন্ত ফাউন্ডেশনে থেকে নিজের চিকিৎসা করাচ্ছেন। এখানে শুধু নারী নয়, সবধরনের ক্যান্সার রোগীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বৃহস্পতিবার ২২ ফেব্রুয়ারি আদাবরে দিগন্ত মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনে গিয়ে জানা যায়, সেখানে ১৮জন রোগী রয়েছেন। এর মধ্যে ১২জন নারী ও ছয়জন পুরুষ। এর আগে একদিন ক্যান্সার হাতপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রেডিও থেরাপি রেজিস্ট্রেশন রুমের (রুম নং ১৫৩) সামনে এক ব্যক্তি দিগন্ত ফাউন্ডেশনের লিফলেট বিতরণ করছেন। তিনি রোগীদের জানাচ্ছেন, ক্যান্সার রোগীদের জন্য থাকা-খাওয়া ও প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসা-যাওয়া মাত্র দুই শ’ টাকায়। কথা হলে তিনি জানান, তার নাম সেলিম। লিফলেটের পেছনে তিনি নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে দেন এবং কারও কোন থাকার ব্যবস্থা না থাকলে, ২০০ টাকায় কেউ থাকতে চাইলে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান। পরে একজন রোগীর স্বজন পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করা হয় লিফলেটের নাম্বারে। ওই নাম্বারে কথা বলা হলে নির্দিষ্ট দিনে ক্যান্সার হাসপাতালে সোহেল নামের এক ব্যক্তি দিগন্ত ফাউন্ডেশনের গাড়ি নিয়ে হাসপাতাল গেটের কাছে রোগীকে নিতে আসেন। কথা হলে সোহেল জানান, আগে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসা-নিয়ে যাওয়া, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করা, কেমো দেয়া ও রেডিও থেরাপি দেয়ার ব্যবস্থা তিনিই করে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সোহেল জানান, রোগীদের কী অবস্থা, রেডিও থেরাপি দেয়া হলো কী না, চিকিৎসক দেখাতে পারল কী না একটু খোঁজ নিতে হবে। পরবর্তীতে সোহেলকে অনুসরণ করে দেখা গেল, তিনি রেডিও থেরাপির ইউনিট ১ এ গিয়ে দেখেন তাদের ওখানে থাকেন এমন দুইজন রোগীর একজনের রেডিও থেরাপি দেয়া হয়েছে। আরেক জনের হয়নি। তিনি টেকনিশিয়ানদের রুমে গিয়ে তাদের রোগীকে একটু আগে দিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এ সময় তারা সেই রোগীকে রেডিও থেরাপি দিয়ে দেন। দিগন্ত ফাউন্ডেশনের ম্যানেজার ইলিয়াস হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দিগন্ত নামের একটি ছয় বছরের শিশুর নামে এটার নামকরণ করা হয় দিগন্ত ক্যান্সার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন। দিগন্তের বোন ক্যান্সারে সিঙ্গাপুরে মারা যায়। ওই শিশুর যে কষ্ট, সেই কষ্ট থেকেই এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পায়। তখন শিশুদের নিয়ে একেবারেই বিনামূল্যে এই প্রতিষ্ঠান শুরু করা হয়। শুরুতে ২০জন শিশু রাখার ধারণ ক্ষমতা ছিল। এখন জেনারেল করা হয়েছে। নারী পুরুষ সবাই থাকতে পারেন। এখন ৩০জনের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। শিশুদের জন্য এখনও সব ফ্রি। সঙ্গে যদি অভিভাবক থাকতে চান সে ক্ষেত্রে ওই দুই শ’ টাকা করে নেয়া হয়। ম্যানেজার বলেন, শিশু ছাড়া নারী বা পুরুষ রোগীদের থাকা খাওয়া, আমরা আমাদের গাড়িতে করে মহাখালী হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসা নেয়ার পর আবার নিয়ে আসি। এই সব কিছুর জন্য দৈনিক দুই শ’ টাকা করে নেয়া হয়। স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে রোগীদের পুষ্টিকর খাবার বলতে দুধ, ডিম, ফলমূল এসব খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া যারা একেবারেই গরিব রোগী, যাদের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই, তাদেরও রেখে চিকিৎসা করাই। কিছু টাকা পয়সা দিয়েও সহযোগিতা করি। দিনে তিন শিফটে ভাগ করে হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া হয় জানিয়ে ইলিয়াস হোসেন বলেন, রোগী যখন আমাদের এখানে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন আমরা দেখি তার কোন সময়ে থেরাপি দেয়ার কথা রয়েছে। সেই সময় হিসেবে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কারও যদি সকাল ১০টায় থাকে তাকে সকালের শিফটে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজ শেষ হলে আবার ১১টায় তাকে নিয়ে এসে আরেক শিফটের জন্য অন্যদের নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ যার বিকেলে থাকে তাকে তো সকালে নিয়ে হাসপাতালে বসিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। কীভাবে বা কারা এই ফাউন্ডেশন চালান জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ফাউন্ডেশনের সরকারী বা বেসরকারী কোন ফান্ড নেই। কয়েকজন চিকিৎসক আর ব্যবসায়ীর দেয়া সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠান চলে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে থাকা অবস্থায় যদি কোন রোগী মারা যান আমরা তাদের দাফনের টাকা পয়সা সব দিয়ে দেই। এখানে শিশুদের খেলাধুলা ও রোগীদের বিনোদনেরও ব্যবস্থা আছে। এই প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন করা রোগীদের তারা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ম্যানেজার বলেন, সাইফুল ইসলাম (৪২) হাইপো প্যারিং নিয়ে নতুন আসছেন। এখনও তার থেরাপি শুরু করা হয়নি। দ্রুত তাকে যাতে থেরাপি দেয়া হয় সেই জন্য আমরা আবেদন করেছি। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্যান্সারে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীরই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসেন। কিন্তু সুচিকিৎসা নিতে আসা দরিদ্র ব্যক্তিরা অনেকেই জানেন না তারা ঢাকায় এসে কোথায় থাকবেন, কী করবেন? তাদের জন্য এই প্রতিষ্ঠান একটা আশির্বাদস্বরূপ। দিগন্ত ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকে। তারা মনে করছেন, এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গ্রামের রোগীরা জানে না, তাই কোথায় থাকবে কী করবে সেই ভয়ে চিকিৎসা করাতে অনেকেই রাজধানীতে আসতে চান না। সেজন্য এটার প্রচার বাড়ানো, সেই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের পরিসর আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
×