ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ব্যক্তিস্বার্থে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন দলের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের পরিপন্থী’

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

‘ব্যক্তিস্বার্থে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন দলের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের পরিপন্থী’

বিডিনিউজ ॥ খালেদা জিয়ার মামলার রায় সামনে রেখে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা সংক্রান্ত সপ্তম ধারা বিলোপের যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছে, তা দুর্নীতি নিয়ে তাদের দলীয় অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত এসেছে বিশ্লেষকদের কাছ থেকে। তারা বলছেন, গঠনতন্ত্র সংশোধন হওয়া উচিত দলের প্রয়োজনে, ব্যক্তির স্বার্থে নয়। আর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় এমন অবস্থানও কোন দলের কাছ থেকে কাম্য হতে পারে না। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ‘দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে’ জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা কর্মসূচী দিয়েছিলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক’ সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তার অন্যতম। কিন্তু বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বিলুপ্ত করায় দুর্নীতিতে দণ্ডিত ব্যক্তির দলের কমিটিতে সদস্য হতে বাধা থাকছে না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বিডিনিউজকে বলেন, বিএনপির একটা ভয় ছিলÑ যদি দুর্নীতির দায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের শাস্তি হয়, তাহলে তার সদস্য পদও থাকবে না, নির্বাচনও করতে পারবে না। তার মতে, নেতৃত্ব ধরে রাখতেই বিএনপি গঠনতন্ত্রে ওই সংশোধনী এনেছে। আর এই সংশোধনীকে সাংঘর্ষিক বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সঙ্কট ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের যে অবস্থান তার সঙ্গে গঠনতন্ত্রের এ পরিবর্তন সাংঘর্ষিক। তড়িঘড়ি সংশোধন ॥ জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। সেই সঙ্গে তার ছেলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে দেয়া হয়েছে ১০ বছর করে কারাদণ্ড। বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জরুরী অবস্থার সময় এ মামলা দায়ের করেছিল দুদক। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারক বলেছেন, সরকারী তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাত করে খালেদা জিয়াসহ আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন। ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা হওয়ায় আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়া এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। তবে হাইকোর্ট তার আপীল গ্রহণ করলে বিচারিক আদালতের ওই রায় স্থগিত হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে বিএনপি নেত্রীর সামনে। কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্য আরও একটি বিপদ ছিল দলীয় গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারায়। সেখানে বলা ছিল, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোন পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। সেই বিপদ এড়াতে রায়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২৮ জানুয়ারি বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়। অবশ্য সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। আট পৃষ্ঠার ওই সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে দলীয় চেয়ারপার্সন ও কাউন্সিল অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে খালেদা জিয়া ইসিতে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘উপরোক্ত সংশোধনীগুলো কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হলে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদন করে। একই সঙ্গে কাউন্সিলের গৃহীত সংশোধনী অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদগুলোর ক্রমিকের অনিবার্য পরিবর্তন, ভাষা ও ছাপার ভুলগুলো সংশোধন করার প্রস্তাবও কাউন্সিলের অনুমোদিত হয়।” ‘ব্যক্তির জন্য দলের নিয়ম বদল’॥ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নিবন্ধিত হওয়ার সময়ই দলীয় গঠনতন্ত্র জমা দিতে হয়। আর সংশোধন করা হলেও তা নির্বাচন কমিশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোন দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো কিনা, তা দেখা ইসির দায়িত্ব। বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রে যে পরিবর্তন এনেছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি কে এম নূরুল হুদা সোমবার বলেন, আমরা তো তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করব না। তারা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে। ওই সংশোধনী নীতিসিদ্ধ হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে কোন মন্তব্য করেননি সিইসি। তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করছেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বিলোপের উদ্দেশ্য কেবল একজন ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা। গঠনতন্ত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়। কিন্তু এ পরিবর্তনটা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়নি, হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আরইডব্লিউজির পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, দলকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক, কোন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় বা এ ধরনের অবস্থান কখনও কাম্য নয়। অবশ্য বিএনপির এ অবস্থানকে তাদের ‘সঙ্কট মোকাবিলার কৌশল’ বলে মনে করছেন রাজনীতির বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী, যিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, দলীয় গঠনতন্ত্রের এ সংশোধন দলীয় ব্যাপার। প্রয়োজন মতো দল সংশোধন করে। এখন বিএনপি কতটুকু সর্বসম্মতভাবে ও নৈতিকভাবে সংশোধন করেছে তা নির্ভর করছে বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর। নির্বাচনের বছরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের ওই রায় নিয়েও ‘জনমনে সন্দেহ’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির সাবেক এই নেতা। নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণভাবে সংশোধনী আনে, তা দলটির কৌশল হতে পারে।ৃ দেখতে হবে এ কৌশল বা চালে কার বেশি লাভ হচ্ছে। প্রধান দুই দলই চাল খেলছে। নির্বাচনে বা আন্দোলনে সফলতা এলেই তাদের চাল স্বার্থকতা পাবে; ব্যর্থ হলে চাল ভুল ছিল প্রমাণ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের আগে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনের সমালোচনা করেন। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, মেজর কোন পরিবর্তন হয়নি... আজকে বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তাদের এত আশঙ্কা কেন, ভয় কেন? উনি নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না... নির্বাচন না করতে পারলে আপনার সুবিধা হয়, আমরা ভাল করেই বুঝি।
×