ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও রোহিঙ্গা ঢল, ২৪ ঘণ্টায় এসেছে সহস্রাধিক

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আবারও রোহিঙ্গা ঢল, ২৪ ঘণ্টায় এসেছে সহস্রাধিক

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ দুদেশের মধ্যে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে তমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের জিরো লাইনে অবস্থানরত ছয় সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত প্রচার হওয়ার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গাদের গন্তব্য বাংলাদেশমুখী হয়েছে। বুধবার সকাল পর্যন্ত সেখান থেকে এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আবারও বড় একটি রোহিঙ্গা ঢল চলে আসতে পারে এ আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদারের পাশাপাশি নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে দিন দিন প্রত্যাবাসিত না হওয়ার তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্টো জিরো লাইন থেকে রোহিঙ্গাদের কিভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসা যায় কয়েকটি এনজিও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো জানিয়েছে, কিছু এনজিও এ কাজ করছে তাদের জন্য দেশী বিদেশী ফান্ড সংগ্রহ করা এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এ কাজে লিপ্ত হয়েছে অর্থের বিনিময়ে। মঙ্গলবার রাত ও বুধবার ভোরে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে বিজিবি আটক করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ইতোপূর্বে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত স্বজনদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে। এদের কোন নিবন্ধন কাজও হয়নি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমার পক্ষ যত কথাই বলুক না কেন মূলত সেখানে তাদের বসবাসযোগ্য কোন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। যা হচ্ছে- তা আশ্রয় ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের রাখা হবে। কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের বসতভিটা ফেরত না পেলে ওসব ক্যাম্পে বন্দী জীবনে যেতে রাজি নয়। রোহিঙ্গাদের পক্ষে জানানো হয়েছে তাদেরকে সেখানে মানবেতর জীবনে রাখা হবে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর তারা ত্রাণ সহায়তাসহ প্রাণরক্ষার যে আশ্রয়স্থল পেয়েছে সে পরিস্থিতি ওপারে তৈরি করা হবে না। এছাড়া উগ্র মগ সন্ত্রাসী এবং সঙ্গে সেনা ও পুলিশের অভিযানে আকস্মিক বিপদের সম্ভাবনা থাকবে সর্বক্ষণ। তমব্রু সীমান্তের স্থানীয় অধিবাসীরা জানিয়েছেন, মূলত মঙ্গলবার দুদেশের পক্ষে জিরো পয়েন্টে অবস্থানরতদের সে দেশের অভ্যন্তরে ফিরিয়ে নেয়ার খবর প্রচার হওয়ার পর রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করেছে। পালিয়ে তারা রাখাইনে যাচ্ছে না, অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে। পাশাপাশি টেকনাফ ও উখিয়ার বারো ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশে চলে আসার উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মূল দাবি তাদের ছয়দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসিত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে নতুন অনুপ্রবেশকারী সৈয়দ আহমেদ জানান, ১৯৯২ সালের পর থেকে বাংলদেশে আসা বহু রোহিঙ্গা এখানে রয়ে গেছে। এদের অনেকে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব, জন্ম নিবন্ধন কার্ডও পেয়ে গেছে। বর্তমানে যারা নতুন এসেছে তাদের আগে পুরনোদের ফেরত পাঠাতে হবে। এরপর যেতে হলে নতুনরা যাবে। রোহিঙ্গা নারী নুর বেগম জানান, বহু কষ্ট করে বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়েছি। আগে যা শুনেছি তা গল্পের মতো মনে হতো। এখন দেখছি এখানে রোহিঙ্গারা যেভাবে আছে তা গল্পকেও হার মানাচ্ছে। সুতরাং ভাল অবস্থান থেকে বিপদের মুখে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। অনেক বিদেশী প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে। কিন্তু রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও রোহিঙ্গাদের অনুকূলে নয়। এখানে চলে আসার আগে বহু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে রোহিঙ্গা বসতির ধংসযজ্ঞগুলো মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। আগামীতে রাখাইন রাজ্যে বিদেশী পর্যবেক্ষকরা এলে ধংসযজ্ঞের কোন চিহ্নই দেখবে না। রোহিঙ্গা মাঝিরা জানিয়েছেন, মূলত মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করার প্রক্রিয়া বেছে নিয়েছে, যাতে সেখানে কোন ধংসযজ্ঞ না থাকে। এসব ধংসযজ্ঞ মুছে ফেলতে এখন চলছে জোর তৎপরতা। এছাড়া নতুন করে রাখাইন রাজ্যে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। যা আরও বিপদজনক। তমব্রু জিরো পয়েন্ট থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও মিয়ানমার পক্ষ তা শুরু করেনি। উল্টো চাইছে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসুক। এ বিষয়ে মঙ্গলবারের বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের বৈঠকে সুস্পষ্টভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী সকল রোহিঙ্গাকে তারা ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তা কখন ফিরিয়ে নেয়া হবে তা দিন তারিখ ঘোষণা করেনি। মঙ্গলবারের এ বৈঠকের পর এদেশে কর্মরত কিছু এনজিও ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জিরো পয়েন্ট থেকে রোহিঙ্গাদের এ পারে নিয়ে আসার তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সেনা ও পুলিশের তৎপরতা থাকলেও গত কিছুদিন ধরে রাখাইন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবে প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য ক্যাম্প তৈরির কাজ যেমন চলছে, তেমনি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নতুন নতুন ক্যাম্প নির্মাণ চলছে জোরেশোরে। এসব বিষয় আঁচ করতে পেরে এবারের রোহিঙ্গারা এ মুহূর্তে ওপারে ফিরতে মোটেও আগ্রহী নয়। এর পাশাপাশি জাতিসংঘের মানবাধিকারসহ বিভিন্ন সংস্থাও বলছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া জোর করে কাউকে প্রত্যাবাসন করাও যাবে না।
×