ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালিত্বের বোধ ভাষা চেতনায় উজ্জ্বল দিন

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাঙালিত্বের বোধ ভাষা চেতনায় উজ্জ্বল দিন

মোরসালিন মিজান ॥ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি...। রক্তে ভেসে গিয়েছিল রাজপথ। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চাই। আর কারও ভাষা চাপিয়ে দেয়া চলবে না। ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল বাঙালী। আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে বায়ান্ন। আসে ২১ ফেব্রুয়ারি। সালাম, রফিক, শফিক ও বরকতের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচিত হয়। গৌরবের সেই ইতিহাসটিকেই ধারণ করে আছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মাসব্যাপী আয়োজন তাই এত আবেগের। এত বেশি ভালবাসার। রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুনীল ভোরে ...। এখনও কি ডাকে সে ভোর? হয়ত ডাকে। তা না হলে কেন অমর একুশের দিনে মানুষের সবচেয়ে বড় স্রোতটি নামবে বইমেলায়? অন্যদিনও লোকসমাগম কম হয় না। তবে ২১ ফেব্রুয়ারির স্বতন্ত্র আবেদন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ দিনে মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয় সকাল ৮টায়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সেখান থেকে সরাসরি চলে আসেন বইমেলায়। দল বেঁধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেন তারা। কেউ কেউ যান বাংলা একাডেমিতে। অমর একুশের দিন মেলায় আসার আলাদা মূল্য। বাঙালিত্বের বোধ ভাষাচেতনায় উজ্জ্বল দিন। এদিন পূর্ণতা পায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বুধবার একুশতম দিনটি তাই অন্যরকম ছিল। এক সময় ভাষা শহীদদের স্মরণে কালো রঙের ব্যাজ ধারণ করতেন সবাই। এখন সেটি কালো পোশাকে পরিবর্তিত হয়েছে। আছে সাদা রঙের মিশেল। অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল রং ভাই হারানোর বেদনাকে ধারণ করে ছিল। সাদা-কালো রঙের মিশেলে সুন্দর সাজে এসেছিলেন নারীরা। এমনকি ছোট্ট শিশুটি একুশের রং গায়ে মেখে মেলায় আসে। তবে দৃশ্যমান রঙের চেয়ে মনের ভাব ও ভাষা বেশি মুগ্ধ করেছে। একুশের মেলায় এদিন ভাবগাম্ভীর্যটা চোখে পড়েছে। অবশ্য ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাঙালীর নয়। সারা বিশ্বের। ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অর্জনের এই আনন্দও ছিল পাঠকের চোখে মুখে। বই কেনার পাশাপাশি এদিন চলে আড্ডা গল্প। বেলা যত বাড়ছিল, ততই বাড়ছিল ভিড়। ভিড়, ভ্যাপসা গরম, হাঁটা দীর্ঘপথÑ কোনটিই বাধা হতে পারেনি। বইয়ের সঙ্গে ভাষা দিবস পালন করেছেন নগরবাসী। মেলায় লোকসমাগম বাড়ায় বেড়েছিল বিক্রিও। প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে পছন্দের বই কিনেছেন পাঠক। এর আগে সকাল সাড়ে ৭টায় একুশে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে স্বরচিত কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়। মেলা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। ৩৯০ নতুন বই ॥ এদিন মেলায় এসেছে ৩৯০টি নতুন বই নির্বাচিত বই ॥ সাহিত্য প্রকাশ থেকে মেলায় এসেছে অনন্য সাধারণ একটি গ্রন্থ। তিন খ-ের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন সাংবাদিক হারুন হাবীব। বইয়ের শিরোনামÑ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত : তথ্য ও দলিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা আগেও নানাজন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন। তবে এটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থ বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে তথ্য উপাত্ত দুর্লভ দলিল ইত্যাদি সংগ্রহ ও গবেষণা শেষে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। কাকলী থেকে এসেছে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘একুশের রক্তপলাশ।’ ভাষা আন্দোলনের সেইসব দিনের কথা গল্পের ছলে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বই ‘উনিশ শতকে ঢাকার তিন কবি।’ প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। বইতে উনিশ শতকের ঢাকার তিন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, হরিশচন্দ্র মিত্র ও রাস বিহারী মুখোপাধ্যায়কে তুলে ধরার প্রয়াস। বিখ্যাত সেই কবিদের প্রয়ানের পর তাদের নিয়ে সমসাময়িক অনেকেই লিখেছেন। সেইসব দুষ্প্রাপ্য লেখা সংগ্রহ ও সংকলন করে আজকের পাঠকের কাছে দিয়েছেন মুনতাসীর মামুন। ক্ষণজন্মা নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে লিখেছেন আবু সাঈদ তুলু। লেখক একটি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ান। নাট্যবিশ্লেষক। তার লেখায় কিছু বিশেষত্ব আছে যা সেলিম আল দীনকে বোঝতে সহায়তা করবে। বইটি প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা। একুশে ফেব্রুয়ারির লক্ষ্য কী, অর্জনের পথ কোন দিকে শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের বাঙালী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছে। এর ফলেই সর্বাত্মক ভাষাসংগ্রাম এবং পরিণতিতে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু একুশের পথ বেয়ে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাকে আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তাই উচ্চ আদালতে রায় প্রদানের ক্ষেত্রে এখনও বাংলাকে প্রধান মাধ্যম ভাবা হয় না, তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় একটি শ্রেণীর কাছে ভাষা হিসেবে বাংলা থাকে উপেক্ষিত। তিনি বলেন, এই অবস্থার মূলে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কট। শ্রেণীবৈষম্যের অবসান না ঘটায় সমাজে দারিদ্র্য, শোষণ ও নির্যাতন ঔপনিবেশিক সময়ের মতোই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থার নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির যে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন ছিল তার অনপুস্থিতি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাম্যবাদী সংকল্পের বাস্তবায়নকে সুদূরপরাহত করেছে। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×