ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার জামিন ও পেট্রোলবোমা হত্যা মামলা মানবতাবিরোধী আদালতে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

খালেদার জামিন ও পেট্রোলবোমা হত্যা মামলা মানবতাবিরোধী আদালতে -স্বদেশ রায়

স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব থেকে বেশি মানুষ হত্যা করা ও হত্যার জন্য সহিংসতা চালিয়েছেন খালেদা জিয়া। সিরাজ সিকদার ও জাসদের গণবাহিনীও এভাবে এত মানুষ হত্যা করতে পারেনি। ২০০১-এ নির্বাচনের আগে ও পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এ দেশে গণহত্যা হয়। এর পরেও ২০১২, ১৩ ও ১৫ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এক ধরনের আরবান গেরিলা যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাদের মূল অস্ত্র ছিল পেট্রোলবোমা। এই বোমার আগুনে সহস্রাধিক মানুষ আহত ও শতাধিক মানুষ নিহত হয়। ২০১৫ সালে খালেদা জিয়া এই গৃহযুদ্ধ ও হত্যাকা-ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ৩ মাসের বেশি সময় নিজের অফিসে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন। ঘোষণা দিয়েই সেখানে অবস্থান করেন তিনি। তাই এ মুহূর্তে বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার থেকে সহিংস কোন নেতা নেই। তিনি যে মামলায় এ মুহূর্তে জেলে আছেন, ওই মামলার হাজিরা থেকে ফেরার পথে তার হুকুমেই পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। যারা ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন তারা সকলেই বুঝতে পারবেন হামলাকারীরা উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা সহজেই পুলিশকে আঘাত করে কাবু করে ফেলে। শুধু তাই নয়, তারা পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই করে নেয়। এমনকি খালেদার মামলার রায়ের দিন পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও যেভাবে অতর্কিতে খালেদার গাড়ি বহরে তার দলের সন্ত্রাসীরা ঢুকে যায়, সেটা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো কাজ ছিল না। যার ধরন ছিল সম্পূর্ণ সন্ত্রাসীদের মতো। সেদিন পুলিশ অনেক দক্ষতার সঙ্গে সেটা মোকাবেলা করে ঠিকই, কিন্তু সেই সব সন্ত্রাসী এখনও বাইরে আছে। খালেদা জিয়ার মামলা থেকে হাজিরা দেয়ার পথে যেভাবে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছিল, তা ২০১২, ১৩ ও ১৫-কে মনে করিয়ে দেয়। এমনকি সকলে ধরে নিয়েছিল নির্বাচনের বছরে খালেদার নেতৃত্বে আবার এ দেশে গণহত্যা হবে। দেশের মানুষের সৌভাগ্য, তার কয়েকদিনের ভেতরই দুর্নীতি মামলায় খালেদার জেল হয়েছে। তিনি জেলে আছেন। এই লেখা যখন লিখছি তখন জানতে পারি আইনজীবীরা তার জামিনের জন্য আবেদন করেছেন। যে কোন দ-প্রাপ্ত আসামি জামিনের জন্য আবেদন করতে পারেন উচ্চ আদালতে। আদালত কী সিদ্ধান্ত নেবে তার এখতিয়ার সম্পূর্ণ আদালতের এবং দুদক ও অন্যান্য বিরোধী পক্ষ এখানে খালেদার দুর্নীতির মামলা ও অন্যান্য মামলা নিয়ে জামিনের পক্ষে-বিপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরবেন। বিজ্ঞ আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। খালেদা যদিও একটি মামলায় এখন জেলে, আর সেটা দুর্নীতির মামলা। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তার দলের লোকেরা এই মামলাকে দুর্নীতির মামলা বলছেন না। তারা রাজনৈতিক মামলা বলছেন। তারা যতই অহিংস বলুক না কেন, একটি দুর্নীতির মামলার রায়ের বিরুদ্ধে তারা রাজপথে আন্দোলন করছেন। খালেদার অনুপস্থিতিতে তারা অনেকটা নমনীয় আছেন বা সহিংস পথে যাচ্ছেন না। খালেদা জিয়া যদি কোন কারণে জামিন পান তাহলে এই আন্দোলনকে তারা তখন মামলা প্রত্যাহার বা দ- বাতিল এই ধরনের তথাকথিত সস্তা রাজনৈতিক স্লোগানের মাধ্যমে সহিংস আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাবেন। তাই এ মুহূর্তে খালেদার জামিন দেয়ার অর্থই হলো দেশকে আবার পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা, আবার সরকারী সম্পত্তি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া। আমরা আইন অঙ্গনের মানুষ নই, দেশের সাধারণ নাগরিক। আমরা জানি, বিচার বিভাগ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ Ñ এ কারণে সেই যে মূল কাজ- ‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’-এর এই শেষ ধাপটি রক্ষা করে বিচার বিভাগ। তাই বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা সব সময়ই বেশি। তাই খালেদার জামিন নিয়ে মানুষ বিচার বিভাগের দিকেই চেয়ে আছে শুধু নয়, মানুষ একটা উদ্বেগের ভেতরেও আছে। যদি খালেদার জামিন হয়, তাহলে দেশে আবার পেট্রোলবোমা হামলা, আবার পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারী-বেসরকারী সম্পত্তি ধ্বংস হবে। দেশের মানুষ কোন এক ব্যক্তির জন্য আর কোনমতেই এই হত্যা ও নৈরাজ্য চায় না। বরং তারা আশা করে, খালেদার জামিনের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশের সাধারণ মানুষের, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা ও সম্পদ ধ্বংসের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব পাবে। কারণ, মুক্ত খালেদা মানেই দেশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া। এই পেট্রোলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যা ও অন্যান্য সহিংস কাজের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী সম্পত্তি ধ্বংসের ১০টির ওপর মামলায় খালেদা হুকুমের আসামি অর্থাৎ সুপ্রীম রেসপনসিবিলিটি তার। বাস্তবে এই মামলাগুলো সাধারণ কোর্টে চলবে, না মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাবে, সে সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব কর্তৃপক্ষকে এখনই নিতে হবে। কারণ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালস এ্যাক্ট ১৯৭৩ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০১২, ১৩ ও ১৫ সালে বাংলাদেশে যে হত্যাকা- ও সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তা এই আইনের আওতাধীন অপরাধ। কোন মতেই ওগুলো কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। ওগুলো ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের সশস্ত্র যুদ্ধ। যাকে গৃহযুদ্ধও বলা যেতে পারে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই সশস্ত্র হামলা বা এক ধরনের গৃহযুদ্ধের মূল নেতা বা সুপ্রীম কমান্ডার খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে পেট্রোলবোমায় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ২০১৫ সালের ইত্তেফাকের সিনিয়র সাংবাদিক আবুল খায়েরের একটি রিপোর্টের কিছু অংশ থেকেই বোঝা যায়, তখন এক একটি দিন কতটা বিভীষিকাময় ছিল। ২৫ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখের ইত্তেফাকের ওই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘এত কষ্ট এত যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না’Ñএ রিপোর্টের কিছু অংশ এমন- “ ‘আগুনে পুড়লে এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না। আল্লাহর দোহাই, আমাদের আর পোড়াবেন না।’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ রোগী ও তাদের স্বজনরা এই আকুতি জানান। এদিকে গত শুক্রবার রাতে ডেমরা মোল্লা ব্রিজে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে পিকেটাররা। বাসের ২৭ জন যাত্রীকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এছাড়া ওই রাতে সিলেট থেকে একজন ও বগুড়া থেকে চারজন দগ্ধ যাত্রীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তিন শ’ বেডের হাসপাতালে ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক দগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন। এদের সঙ্গে যুক্ত হলেন ডেমরা, সিলেট ও বগুড়ার ৩২ জন।” ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালস এ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৩ এর (১) ও (২) এ কোন একটি গ্রুপকে হত্যা করলে বা গ্রুপকে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলে সেটা এই মানবতাবিরোধী অপরাধের ভেতর পড়ে। আবার রাজনৈতিক গ্রুপকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এ কাজ করলেও তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী। খালেদার এই হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রগতিশীল সরকারকে ক্ষমতা থেকে সশস্ত্র পথে উচ্ছেদ করা। আর তার জন্য দেশকে অস্থিতিশীল করতে, সরকারকে দুর্বল করতে নির্বিচারে গণহত্যা চালানো। পেট্রোলবোমা মেরে একটি ঘটনায় একটি বাসের ২৭ জন মানুষকে পোড়ানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী খালেদা যে একজন গণহত্যাকারী, তা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকে না। তাই দেশে গণহত্যাকারীর বিচারের নির্দিষ্ট আইন ও আদালত থাকতে এই মামলা সাধারণ আদালতে বিচার করলে ভবিষ্যতে অন্যান্য গণহত্যার বিচার করতে গেলে তখন প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া গণহত্যার বিচার সাধারণ আদালতে নয়, এটা ইন্টারনাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুন্যালে করতে হবে। এই ট্রাইব্যুনালে এর আগে আরেকজন সুপ্রিম রেসপনসিবলের বিচারের উদাহরণ আছে। ১৯৭১ সালের আলবদর নেতা হিসেবে মতিউর রহমান নিজামীর অপরাধের বিচার এই আদালতে হয়েছে। তাই ২০১২, ১৩ ও ১৫-এর গণহত্যার সুপ্রিম রেসপনসিবল হিসেবে খালেদার বিচার অবশ্যই এ আদালতে হতে হবে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে খালেদার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের ও তার বিচার না হলে বাংলাদেশ কোনদিন কলঙ্কমুক্ত হবে না। ২০০১ সালে বাংলাদেশে যে হিন্দু পারসিকুয়েশন হয়েছিল, তার বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার বা যথা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবশ্যই এ ট্রাইব্যুনালে খালেদার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। এতদিন কেন সেটা করা হচ্ছে না, তাও একটা বড় প্রশ্ন। কারণ এই মামলার জন্য যে তদন্ত কাজ তা সম্পন্ন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সীমাহীন পরিশ্রম করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য সে কাজ করেছেন। সেখানে প্রত্যক্ষ আসামিদের নাম আছে। এখন সুপ্রিম রেসপনসিবল হিসেবে খালেদার নাম অবশ্যই এই তদন্ত প্রতিবেদনে যোগ হতে হবে এবং খালেদাসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে এই মামলা অবিলম্বে দায়ের করা প্রয়োজন। যতদিন ২০০১-এর ভোলা, রামশীল, পটুয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাগেরহাটের এই হিন্দু গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচার না হবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী এই বাংলাদেশের কপাল থেকে কালিমা যাবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ মামলা দায়ের করে বিচারের পথে নেয়া সরকারের জন্য একটি অবশ্য কর্তব্য। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে অনেক কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছে। আশা রাখা যায়, এ কলঙ্কও বাংলাদেশের থাকবে না। বরং বাংলাদেশই উদাহরণ হবে পৃথিবীর বুকে যে, মাইনরিটি পার্সিকুয়েশনের অবসান কীভাবে করতে হয়। আর অপরাধীদের কী শাস্তি হয়। শেখ হাসিনা পৃথিবীর তাবত মাইনরিটির জন্য সেই উদাহরণ সৃষ্টি করবেন, এ আশা অমূলক কিছু নয়। বরং বর্তমান বিশ্বে কেবল তাঁর পক্ষেই তা সম্ভব। [email protected]
×