ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ মিনার, প্রভাত ফেরি হাতে ফুল, খালি পা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শহীদ মিনার, প্রভাত ফেরি হাতে ফুল, খালি পা

বয়ঃক্রমে, তখন দশ, শুনলুম, সোনাভাই (জিয়া হায়দার) ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় বছর পূর্তিতে, ১৯৫৩ সালে, পাবনার জেলে ঘানি টেনেছেন। ছিলেন এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। বিপ্লবী হওয়ার হাউশ (শখ) হয়েছিল। কেনই বা হবেন না। গত বছরের (১৯৫২) রক্তাক্ত আন্দোলন, ভাষা দিবস, শহীদের কাতারে ছাত্ররাই শামিল, পাবনাসহ গোটা পূর্ব পাকিস্তানে। শরিক দলে দলে। নিজেকে উৎসর্গ করার মাহেন্দ সময়কাল। জিয়া হায়দার (ছাত্র) একা নন। প্রত্যেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপনকারী। হোক তা সহযোগী। সহকর্মী। সহযোদ্ধা। সামান্যতম। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বিপ্লব, স্বাধীনতার সমন্বয়ী, যোগানদার।’ শরৎচন্দ্রেরও প্রায় একই কথা। বঙ্কিমকে বাদ দিন। কৃষ্ণচরিতের গুণকীর্তন, ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে ওকে বেশ মানায়। ভুলছি না বঙ্কিমের বাংলার কৃষক, প্রজা, রায়তের বিষয়াবলী, সমস্যা, লেখা। সমাজ, সামাজিকতার বিশ্লেষণও। সমর সেনের ভাষায়, তিনি (বঙ্কিম) : ‘বন্দেমাতরম/ধ্বনি ওঠে ঘটিরাম ডিপুটির ঘরে,/যবন দুর্যোগ শেষে আহা মরি শ্বেতাঙ্গ সকাল।’ বঙ্কিম চাটুজ্যে ইংরেজ সরকারের ডেপুটি (ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। আমাদের বিলাভ্ডে বাপজান মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন শেখ, ভারত ভাগের আগে জমিদার, ১৯৪৭ সালের পরে জমিদারির লোপ, মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে কেস্টুবিস্টু (পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন), তাঁর পয়লা ‘ছাওয়াল রোউফ পাকিস্তানবিরোধী? ভাষা আন্দোলনে নেতা?’ বড় আপা বুজান (রিজিয়া) বলছিলেন একবার, ‘আব্বা খুব ক্ষেপে যান। রোউফকে ত্যাজ্যপুত্র করার কথাও কচ্ছিলেন। আমরা কাদেকুটে (কেঁদেকুটে) কোলেম (বললেম) রোফকে জ্যাল (জেল) থেকে ছাড়াইয়ে আনেন, তারপর পিটালে (মারধর) ঠিক হবিনি। আব্বা কোলে (বললে), আচ্ছা, ছাওয়ালেক উচিত শিক্ষা দিতি হবি।’ -আব্বা বোধ হয় ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পারেননি। কিংবা পেরেছিলেন। রউফের অনুজ দুলাল (রশীদ হায়দার) বলেন, ‘সোনাভাই বিপ্লব ভোলেননি, বিপ্লব অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছেন। নাটকে। বাংলাদেশে আজকে যে নাটকের জোয়ার, বিপ্লব, সোনাভাইয়ের হাতে তৈরি।’ এডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাস করে জিয়া হায়দার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। একাডেমিক লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে নারায়ণগঞ্জ তুলারাম কলেজের অধ্যাপক। তার আগে, পড়াকালীন, দু-তিনটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা। বাপের কাছে টাকা না নিয়ে ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো।’ জিয়া হায়দারের আস্তানা তখন ২৩ বেচারাম দেউড়ি। একটি বড় ঘর। বাড়ির মালিক ‘কেটিআপা।’ বিখ্যাত সাংবাদিক জহুর হুসেন চৌধুরী ওঁর স্বামী। জিয়া হায়দারের সঙ্গে রশীদও একই ঘরের বাসিন্দা। রশীদকে ছোটরা দাদুভাই বলি। ডাক নাম দুলাল। ১৯৬২ সালে, মা, স্বপনসহ পাবনার দোহারপাড়া থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ‘ভিজিট’ করতে এলুম। একই ঘরে বাস। ঘরে তিনটি চৌকি। এক কোণে রান্নাবাড়ি। এই ঘরকন্নে দেখে স্বপন (জাহিদ)-এর কথা, ‘আমাদের হেঁসেলের চেয়েও ছোট।’ রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলা বিভাগে। পার্ট টাইম চাকরি ‘চিত্রালী’ ও ‘পরিক্রম’। সোনাভাইও (জিয়া হায়দার) চিত্রালীর সঙ্গে গাঁট বেঁধেছিলেন কিছুকাল। দাদুভাইয়ের দায় ছিলেন দুই অনুজকে ঢাকা শহর ‘দেখানোর।’ ঢাকা বলতে গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, বড়জোর পুরানা পল্টন। সিদ্ধেশরীর পরে বাকি অঞ্চল অজপাড়াগাঁ। কে যায় ডোবা, খানাখন্দ, খালবিল দেখতে। দিনে সন্ধ্যায় শেয়ালের ডাক শুনতে। জোঁকের কামড় খেতে। পচা শামুকে পা কাটতে। কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক দেখে মন ছলকায় না, কিন্তু, শহীদ মিনারের কাছে এসে মনে হলো, ভাষা আন্দোলনের কারণেই সোনাভাই জেল খেটেছেন। নিশ্চয় মহার্ঘ এই স্থাপত্য (যদিও তখন পুরোপুরি নির্মিত। একাংশ আধাখ্যাচড়া, শেষ হয়নি কাজ)। বয়স যখন বেশি, যৌবনের ঝামেলা শুরু, মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে যেতে যেতে (সাইকেলে) হঠাৎই মনে হয়, নূরুল আমিনের দোর্দ- প্রতাপ সরকার, এতখানি জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণে বাধা দেননি কেন, বা দ সাধেননি কেন? সরকারী জায়গা, বহু রকম হুজ্জোতি করতে করতে পারতেন, কেন করেননি? এও ভাবি, সাধ্য ছিল না করার, জনজোয়ারে ভীতু, মাথা নত। বাধা দিলে বাধবে লড়াই। জনগণের দাবির কাছে অসহায়। দুই বছর পরে (১৯৬৪ সালে) পাবনার দোহারপাড়ার দিগন্তবিহীন স্বাধীনতা ছেড়ে, অবাধ রাজ্যপাট ভুলে ঢাকার ১৪/২ মালিবাগে মা-ভাইবোনসহ, আড়াইরুমের কুঠুরিতে আবাস। ছয় বছর পরে এখানেই তৈরি হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। প্রতিষ্ঠাতা জিয়া হায়দার। ঢাকায় ভর্তি হলুম সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলে। হেড মাস্টার আমিরুল ইসলাম মুসলিম লীগ অন্তঃপ্রাণ। দাড়ি খামচিয়ে ছাত্রদের দিকে বাঁকা চোখে তাকান, স্কুলে মস্কো গু-ারা (ছাত্র ইউনিয়ন) ঢুকেছে, এই গুঞ্জরণে বিশ্বাসী। ইসলাম, পাকিস্তান, আইয়ুব খান একীভূত। একুশে ফেব্রুয়ারি স্কুলে ছুটি নয়। গুপ্তচর কিছু ছাত্র, কয়েক শিক্ষকের কোন কোন ছাত্র শহীদ মিনারে, প্রভাত ফেরিতে গিয়েছিল। গেলেও কোন ছাত্র স্বীকার করে না। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় (৬-১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫) পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশ কাহিল থেকে কাহিলতর। যুদ্ধ মূলত পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু রাতে কার্ফ্যু এবং ব্ল্যাক আউট। যুদ্ধ প্রায় শেষ দিকে, রেডিও-টিভিতে (পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও-টিভি) রংপুরে না দিনাজপুরে কোথায় যেন ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ করেছে। ঘটনা মিথ্যা। পরে প্রমাণিত। পাকিস্তান বিমানবাহিনীই বোমা নিক্ষেপ করে। এই একটি ঘটনায় মানুষের চোখ খুলে যায়। শুরু হয় বলাবলি, পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধকালেও কোন নিরাপত্তা দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী ইস্যু পেয়ে যায় আইয়ুব ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। যুদ্ধশেষে, মাস দু-তিনেক পরে, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজসহ আরও কয়েকটি বিখ্যাত কাগজের সাংবাদিক এবং কিছু খ্যাতনামা (যাদের নাম কানে ঢুকলে চোখ বন্ধ হয়, মাথা নত হয়, আ হা, আ হা করি, শিরোপা দিই প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী) কবি-সাহিত্যিক-গীতিকার অধ্যাপক আইয়ুবের আমন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধাঞ্চল (যে অঞ্চল যুদ্ধজয়ী। যেমন খেমকরণ সেক্টর।) ভ্রমণ করে, ঢাকায় ফিরে দৈনিক পাকিস্তানসহ আরও তিন-চারটে কাগজে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শৌর্যবীর্য গৌরবের গুণকীর্তনে জাবালিমুনি। ১৯৬৫ সালে, পাক ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী আরও সচেতন, আরও স্বাধিকারকামী, আরও স্বদেশী। ১৯৬৬ থেকে শহীদ মিনারে ভিড় বেশি। খুব ভোরে ‘প্রভাত ফেরি।’ হাতে ফুল। আজিমপুর গোরস্তানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জমায়েত। যত বছর যায় একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে প্রাণের প্রতীক। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে মানুষ কতটা অকুতোভয়, দীপ্ত না দেখলে অবিশ্বাস্য। শহীদ মিনারে, কবরে যাওয়ার দীর্ঘলাইন। খালি পা। হাতে ফুল। ১৯৭১ সালেও একই দৃশ্য। দেশ স্বাধীনের পরে স্তিমিত। এখন শুনি, প্রভাত ফেরি প্রায় উঠেই গেছে। কবরেও ফুল দেয়ার লোক বেশি নেই। খালি পা চোখে পড়ে না। শহীদ মিনারে আরেক কালচার। রাজনৈতিক দল, নেতানেত্রীর সমাগম, রাত বারোটার পরে। নামেমাত্র ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো’ গান কানে বাজে। সকাল-দুপুরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি কিছু হয় বটে, তাও বাংলা একাডেমির বইমেলার নানা কেতায় ক্রমশ ম্লান। শোক এখন উৎসবে পরিণত। বলতে হচ্ছে করে, ‘দাও ফিরে সেই প্রভাত ফেরি, হাতে ফুল, শিশিরসিক্ত পথে খালি পায়ে হাঁটা। মাথা নত। বিনম্র শ্রদ্ধা।
×