ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা একাডেমির বিকৃত বাংলা, রোমান হরফে অস্বস্তিকর প্রচার

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলা একাডেমির বিকৃত বাংলা, রোমান হরফে অস্বস্তিকর প্রচার

মোরসালিন মিজান ॥ রফিক শফিক সালাম বরকতের বাংলাকে আর কে দেখবে? বাংলা ভাষার ভাল মন্দ দেখার অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি তো বাংলা একাডেমিই। সরকারী এ প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট দায় আছে। আছে গুরুদায়িত্ব। পালন করছে কি? মাঝে মাঝেই প্রশ্ন ওঠে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হওয়ার পর একই প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে। না, এবার খুব বড় ঘটনা নয়। ছোট। তবে বাংলা একাডেমির কর্তা ব্যক্তিদের কর্তব্যবোধ, ভাষা চেতনা, রুচি সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা গত কয়েকদিন ধরেই এ নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন। নিজেদের অস্বস্তির কথা জানাচ্ছিলেন। তাদের অভিযোগ- একুশের মেলায় বাংলা একাডেমি স্বনামে যে রেস্তরাঁ খুলেছে সেখানে রান্নাবান্না হচ্ছে না শুধু, ভাষার বিকৃতি দৃশ্যমান। রেস্তরাঁর প্রতিটি দেয়ালে অস্বস্তিকর ইংরেজী। বাংলা ইংরেজীর মিশেল। এই নিকৃষ্ট চর্চা, এই বিকৃতি আর যে কেউ করুকগে, একাডেমি কেন করবে? খাবারের ব্যবসা করবে বাংলা একাডেমি, প্রয়োজন হলে করুকগে, রোমান হরফে বাংলা লিখে প্রচার চালাতে হবে কেন? অমর একুশের মেলা যেহেতু, যেহেতু বাংলা একাডেমি, তাই প্রশ্নটি উঠেছে। মেলায় একাডেমির নামে রয়েছে দুটি রেস্তরাঁ। বড়টি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার মেলার ২০তম দিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিরাট দোকানদারি। বিশাল খাবারের দোকান খুলে বসেছে বাংলা একাডেমি। প্রবেশপথে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বাংলা একাডেমি ক্যান্টিন।’ এর ঠিক নিচে খোলা জায়গায় দাউ দাউ করে চুলা জ্বলছে। ডুবো তেলে লুচি ভাজা হচ্ছে। আরেক পাশে চলছে মুরগির মাংসে মসলা মাখানোর কাজ। বাণিজ্য মেলার চেহারা। ভেতরে বসে খাচ্ছে মানুষ। রেস্তরাঁর বিভিন্ন দেয়ালে খাবারের ছবি। ছবির ওপর রোমান হরফে বিচিত্র কথা লিখে রাখা হয়েছে। পড়তে গিয়ে সত্যি লজ্জায় ডুবতে হলো। খুব চেনা চটপটির ছবির ওপরে লিখে রাখা হয়েছে- ‘HEY CHOTPOTI, YOU LOOK NICE.’ তেহারির ছবির ওপরে লিখে রাখা হয়েছে- ‘HEY CHOTPOTI, YOU LOOK NICE.’ ফুচকার ছবির পাশে লেখা রয়েছে ‘HEY FUSKA,YOU LOOK NICE’, শিক কাবাব দেখিয়ে বলা হচ্ছে- ‘HEY SEEK KABAB, YOU LOOK NICE.’ এমন আরও অনেক কথা। এভাবে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ আর ইংরেজীর ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা’ করা হয়েছে! খেতে বসা বেশিরভাগ মানুষই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিলেন। আর যারা একটু সচেতন, ভ্রু’কুচকে দেয়ালের দিকে তাকাচ্ছিলেন। কেউ কেউ রেগে মেগে অস্থির। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ভাষাসংগ্রামী লেখক আহমদ রফিকের সঙ্গে। বাংলার ব্যাপারে একচুলও ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। তাই হয়ত দুঃখটা বেশি। বলেন, এটাই বোধহয় বাকি ছিল। একে একে সব জায়গা থেকেই তো উধাও হয়ে যাচ্ছে একুশের চেতনা। এখন লেখাপড়াজানা শিক্ষিতসমাজ ঔপনিবেশিক রাজভাষা এবং রাজসংস্কৃতির চর্চা করছেন। এটি আসলে অপচর্চা। বাংলা একাডেমির উদাসীনতা অসচেতনতার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক। এদিন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সুবর্ণ’র স্টলে বসে কথা হয় ইতিহাসবিদ লেখক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, এটা তো অবশ্যই অরুচিকর হলো। ইংরেজীতে সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলা একাডেমির মেলায় অকারণে ইংরেজীর ব্যবহার, রোমান হরফে বাংলা লেখা হবে কেন? এতে করে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তরুণদের মাঝে ভুল বার্তা যায়, যেভাবেই যাক, যাচ্ছে তো। যারা কাজটি করেছেন, যারা তত্ত্বাবধানে আছেন, তাদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বৃহৎ পরিসর মেলা ঘুরে ক্লান্ত সংস্কৃতির্মীরাও বাংলা একাডেমির রেস্তরাঁয় গিয়ে কখনও সখনও বসেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কয়েকজনকে সেখানে বসা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তারা কি দেখেছেন বিকৃতি? এমন প্রশ্নে সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, দেখতে হলো তো। বাংলা একাডেমির নাম মনোগ্রাম ব্যবহার করে একটি রেস্তরাঁ খুলা হয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে অবহেলা উদাসীনতা অত্যন্ত বেদনার। এটি ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে খানিকটা হলেও ম্লান করে। এমন দৃশ্য দেখার পর বাংলা একাডেমি কারা চালায় সে সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেবে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজী ভাষাটিকেও রেস্তরাঁটিতে বিকৃত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সাধারণ একজন পাঠকের সঙ্গেও কথা হয়। হাসান নামের ওই পাঠক বলেন, মেলায় বাংলা একাডেমি একটি খাবারের দোকান দিয়েছে। এটাই তো বিকৃতি। এটাই তো অস্বস্তিকর। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির বক্তব্য জানতে কথা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এমন কোন বিকৃতির খবর আমাদের জানা নেই। ২০ দিন ধরে চলছে মেলা। এর পরও জানা হয়নি? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, হয়ত আমাদের নজরে আসেনি। রেস্তরাঁটি বাংলা একাডেমির কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেই করুক, কাজটি ঠিক হয়নি। বাংলা ভাষার সৌন্দর্য মিষ্টতা আমাদের রক্ষা করতেই হবে। যারাই দূষণের সঙ্গে যুক্ত তাদের গ্রহণ করা হবে না। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা ধরে রাখতে একাডেমি কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, রেস্তরাঁয় যা হয়েছে, আমরা দেখে ব্যবস্থা নেব। ১২৪ নতুন বই ॥ মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ১২৪টি। আজ শুরু সকাল ৮টায় ॥ আজ অমর একুশের দিনে মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হবে সকাল ৮টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস : বহুত্ববাদ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের চার রাষ্ট্রনীতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আকসাদুল আলম। আলোচনা করেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মাহবুবুল হক। সভাপতিত্ব করেন শামসুজ্জামান খান। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের চার রাষ্ট্রনীতি নানা সময়ে রাজনৈতিক দুর্বিপাকের শিকার হয়েছে কিন্তু নানান সংশোধনীর পর এখনও তার জনমুখী বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। অন্যতম রাষ্ট্রনীতি সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি যদি ধরা হয় উদার সাম্য-ভাবনা, তাহলে সে লক্ষ্য পূরণে কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দৃঢ়তা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৈষম্য-বঞ্চনার সঙ্গেও আপোসের প্রবণতা। স্বাধীন বাংলাদেশ বাঙালী জাতীয়তাবাদের আসন আগের মতো অটুট থাকার যৌক্তিকতা এখন আর রয়েছে বলে বলা চলে না। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জনসংখ্যার যে-অংশ বাঙালী নয় তাদের মর্যাদা এবং অধিকারও এখন সংরক্ষিত। আলোচকরা বলেন, বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে ভাষাভিত্তিক-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশের চার রাষ্ট্রনীতি-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির চেতনাস্রোতে বহুত্ববোধের যে মানবিক ধারণা প্রবাহিত তা সামরিক শাসক ও ছদ্মগণতন্ত্রীরা সংবিধান সংশোধনীর নামে নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের মর্মে মর্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্থাত সংবিধানের আদি মৌলনীতিগুলো লালন করে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সিদ্দিকুর রহমান পারভেজের পরিচালনায় ছিল ‘মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ এর পরিবেশনা। এছাড়া আবৃত্তি পরিবেশন করেন ড. মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, সায়েরা হাবীব, কাজী বুশরা আহমেদ এবং এ এস এম সামিউল ইসলাম।
×