ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ব ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে- মস্কোর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে

কূটনীতিতে মূল শক্তি রাশিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কূটনীতিতে মূল শক্তি রাশিয়া

জার্মানির মিউনিখে তিনদিন ব্যাপী নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউরোপ ও মার্কিন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মতামত ব্যক্ত করলেও একটি বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেন যে, সবকিছুর পেছনে রাশিয়ার হাত আছে এবং এই রুশ তৎপরতার অভিসন্ধি হচ্ছে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিতর্কিত ও হেয় প্রতিপন্ন করা। কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এই জোট মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতি তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেও পাশ্চাত্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাগণ এ অপ্রিয় সত্য মেনে নিতে বাধ্য হন যে, চলমান বিশ্বের অনেক গুরুতর সঙ্কট নিরসনে পরমাণু শক্তির অধিকারী রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেন থেকে উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত সর্বত্র তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারের পক্ষ নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো প্রদানের ক্ষমতা প্রমাণ করে, যে কোন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার উপস্থিতি বা ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। -খবর ইয়াহু নিউজ এ প্রসঙ্গে নরওয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ব্যাকে জেনসেন বলেন, রাশিয়া ছাড়া আমরা কোন রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছুতে পারি না। আমরা যদি কোন ভূ রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছুতে চাই, সেখানেও রাশিয়াকে এর কেন্দ্রবিন্দুতেই দেখা যায়। মিউনিখ সম্মেলনে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার জন্য প্রকাশ্যে রাশিয়াকে ‘ব্যাড গাই’ (দুই লোক) বলে অভিহিত করা হলেও গোপনে গোপনে পাশ্চাত্যের সব রাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার অপরিহার্য ভূমিকা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাগাড়ম্বরের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোট নিয়ে ট্রাম্পের অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার এবং ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে মার্কিনীদের এককভাবে সরে যাওয়ার উদ্যোগের ফলে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে যে অনৈক্যের সুর বেজে উঠেছিল, তা এবারের মিউনিউ নিরাপত্তা সম্মেলনে এসে অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। সম্মেলনে মস্কোর পক্ষ থেকে মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের কথা বেমালুম অস্বীকার করা হয়। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এগিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন। অথচ ইতোমধ্যে মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ ১৩ জন রুশ নাগরিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাই রাশিয়া তার বিরদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করায় মার্কিন নীতি নির্ধারকদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক ড্যান কোর্টস বলেন, ‘একটি বিষয়ে আমি অবাক হয়ে যাই যে, প্রতি বছর রাশিয়া এই সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য এমন কাউকে পাঠায় যার কাজই হচ্ছে সব সত্য বা বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।’ পাশ্চাত্যের সকল দায়িত্বশীল কর্মকর্তার প্রায় একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেলেও বাস্তব চিত্র ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টোল্টেনবার্গসহ অনেক দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার হোটেল কক্ষে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাতে মিলিত হতে দেখা গেছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার প্যাব্রিয়েল পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার নমনীয় ভূমিকার বিনিময়ে দেশটির বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হ্রাস করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য লাভরভের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাত করেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধের জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টায় রাশিয়ার ভূমিকা অপরিহার্য। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, পশ্চিমের সামনে এখন যে সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করেছে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সঙ্কট পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। যেমন- রাশিয়া সিরিয়ায় অবস্থানরত ইরানের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ, আর ইরান ইসরাইলের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী। অপরদিকে মস্কো ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অব্যাহতভাবে মদদ দিচ্ছে, যা ন্যাটোকে ক্রমাগতভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। অপরদিকে ন্যাটোভুক্ত অন্যতম দেশ তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তুরস্ক এখন বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করছে এবং রুশ সম্মতি নিয়ে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে মার্কিন সহায়তাপুষ্ট কুর্দীদের ওপর বিমান ও ট্যাঙ্ক হামলা চালাচ্ছে। এতো গেল মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের কথা। এশিয়ার এক প্রান্তে অর্থাৎ দক্ষিণ পূর্ব দিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ ও আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে মার্কিনী ও তার মিত্রদের মাথাব্যথার উপশম বহুলাংশে নির্ভর করে রাশিয়া ও তার মিত্র চীনের উপর। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করার জন্য বারংবার রাশিয়াকে অনুরোধ করেছে। কিন্তু সে অনুরোধ বা আহ্বানে কোন কাজ হয়নি। তাই পশ্চিমা দেশগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেও উত্তর কোরিয়াকে বাগে আনতে পারেনি।
×