ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নবীন লেখকদের পাঠক সমাদৃত কিছু বইয়ের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নবীন লেখকদের পাঠক সমাদৃত কিছু বইয়ের কথা

বিমনোয়ার হোসেন ॥ প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় বের হয় কয়েক হাজার বই। এই বিপুলসংখ্যক বইয়ের সবগুলোই লেখেন না খ্যাতিমান লেখকরা। গল্প-উপন্যাস, কবিতাসহ বিবিধ বিষয়ের অধিকাংশ লেখাই আসে তরুণদের হাত থেকে। সেই সূত্রে একুশের গ্রন্থমেলায় বরাবরই এগিয়ে থাকে নবীন লেখকদের গ্রন্থসম্ভার। উৎকর্ষের বিবেচনায় এসব লেখকের বেশিরভাগ বই মানহীনতার কারণে ছুঁতে পারে না পাঠকের মনন। অজস্র নবীন লেখকের ভিড়ে মানের বিবেচনায় পাঠক সমাদৃত হন স্বল্পসংখ্যক। তারুণ্যের জয়গান গাওয়া তেমন লেখকদের পাঠকসমাদৃত কিছু বইয়ের কথা বলা হলো এই লেখায়। গ্রন্থমেলার বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বেরুনো তরুণদের সেসব বইয়ের খোঁজখবর নিয়ে সাজানো হয়েছে প্রতিবেদন। তরুণ লেখকদের মধ্যে এ বছর গ্রন্থমেলায় আলো ছড়াচ্ছেন স্বকৃত নোমান। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়েছে এই কথাশিল্পীর পাঠকসমাদৃত গল্পগ্রন্থ ‘ইবিকাসের বংশধর’। বাংলার হাওড়, বাঁওড়, বন-বাদাড়, প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্রের পাশাপাশি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভাবনাতাড়িত ১৬টি গল্পে সজ্জিত বইটি পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। এছাড়া আলোঘর প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে এই লেখকের উপন্যাসবিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘উপন্যাসের পথে’। সমকালীন সাহিত্যে নবীনদের উত্থান প্রসঙ্গে এই লেখক বলেন, গত ১০ বছর ধরে তরুণরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে সাহিত্য ভুবনে। কারণ, প্রবীণ লেখকদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছে, আবার অনেকেই নিষ্ক্রিয়। আর সেই শূন্যতার জায়গাটি ভরাট করেছে নবীনরা। এই লেখকদের মধ্যেই প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও কবি রয়েছে। যদিও প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্যের জায়গাটি এখনও ফাঁকা রয়েছে। সেটিও একসময় পূরণ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে তরুণরাই আমাদের শিল্প-সাহিত্যের হাল ধরবে। যেসব তরুণ লেখকরা পাঠকের কাছে পৌঁছুতে চান তাদের অবশ্যই পঠন ও দেখনের অভিজ্ঞতাকে শাণিত করতে হবে। দেখা ও পড়ার সমন্বিত সেই শাণিত অভিজ্ঞতার আশ্রয়ে তারা অগ্রসর পাঠকের কাছে সমাদৃত হবেন। তরুণ লেখকদের বইয়ের প্রকাশনা প্রসঙ্গে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের প্রকাশক কামরুল হাসান শায়ক বলেন, যে কোনো বয়সের মানুষের লেখাই আমরা প্রকাশ করি। হতে পারে তরুণ কিংবা কিশোর। এখানে লেখার মানটাই বড় বিষয়। তাই স্ক্রিপ্ট ভাল হলে একেবারে নতুন লেখকের বইও প্রকাশ করি। এখন অজস্র তরুণ লিখছে। তবে সবার লেখা মানসম্মত নয়। সেক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই যারা ভাল লিখছে তাদেরই এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা থাকে আমাদের। সে কারণেই এবার প্রকাশ করেছি গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক সঙ্গীতা ইমামের প্রথম বই ‘আমাদের গল্প’। সোমবার দুপুর গড়ানো বসন্ত বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণে দেখা হয় তরুণ কবি মাজহার সরকারের সঙ্গে। কথা হয় দেশ পাবলিকেশন্স থেকে আসা তার রচিত ‘প্রিয়তমো সুন্দর সময় চলিয়া যায়’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। বললেন, নবীন কবি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালই সাড়া পাচ্ছি। পাঠকরা আগ্রহ নিয়ে বইটি নেড়েচেড়ে দেখছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার দু-একটি কবিতার ভাললাগার রেশ ধরে সংগ্রহ করছে বইটি। তাছাড়া একুশে গ্রন্থমেলার মতো বিশাল ক্যানভাসের মননশীল আয়োজন নবীন লেখকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। লেখনীটা ভাল হলে এ মেলার মাধ্যমে পাঠকের মনন ছোঁয়ার সুযোগটি পাওয়া যায়। পাঠক স্পর্শ করা আরেক তরুণ কবি ও লেখক পিয়াস মজিদ। এবারের মেলায় গদ্য-পদ্য মিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছয়টি গ্রন্থ। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে বেরুনো এই কবির ‘নাচ, মারবেল ও গোধূলি’ কাব্যগ্রন্থটি পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। এছাড়া এতিহ্য থেকে এসেছে কাব্যগ্রন্থ ‘ছোট কবিতা’। আলোঘর প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আমার রবি আমার ইন্দ্র’। অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ ও অন্যান্য’, সময় থেকে এসেছে ‘স্মৃতিপাখির ওড়াওড়ি’ এবং ছায়াবীথী থেকে বেরিয়েছে ‘পড়ার টেবিল থেকে’। আগামী থেকে আসা মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর ‘বড়ো শহরের ছোটগল্প’ নামের গল্পগ্রন্থটির রয়েছে পাঠক চাহিদা। ‘নেভার স্টপ লার্নিং’ নামের প্রবন্ধগ্রন্থের মাধ্যমে মানবিক সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বিকাশের ভাবনা মেলে ধরেছেন আয়মান সাদিক। অধ্যয়ন প্রকাশন থেকে বেরুনো বইটির পরিবেশক তাম্রলিপি। আয়মান সাদিকের বইটি বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় রয়েছে জানান এই প্রকাশনা সংস্থার বিপণন কর্মী নূরুল কবির। তরুণ লেখক ইকবাল খন্দকারের ‘ভুতুড়ে ডাকঘর’ নামের ভৌতিক গল্পগ্রন্থটি দারুণভাবে টানছে পাঠক। বইটির প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, আমাদের বহুল বিক্রীত বইগুলোর তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে এই লেখকের বইটি। এছাড়া তরুণ লেখকদের পাঠক সমাদৃত বইয়ের মধ্যে আছে ভাষাচিত্র থেকে বেরুনো সাদাত হোসাইনের উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’। পাঠকপ্রিয় হয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে আসা মোজাফ্ফর হোসেনের উপন্যাস ‘খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক’। পাঠক টানছে সময় প্রকাশন থেকে বেরুনো হাবিবুল্লাহ ফাহাদের উপন্যাস ‘দরজার ওপাশে ভোর’ এবং ইমরোজ সোহেলের কাব্য উপন্যাস ‘মৃত্যুর পালঙ্কে শুয়ে’। দ্যু প্রকাশন থেকে এসেছে প্রমা ইসরাতের ছোটগল্পের বই ‘লাভ-লোকসান’ এবং বৃত্বা রায় দীপার কাব্যগ্রন্থ ‘নৈঃশব্দের কারুকাজ’। গড়পড়তায় ভাল চলছে ঐতিহ্য থেকে আসা আফতাব হোসেনের উপন্যাস ‘বনলতা’ এবং আগামী থেকে বেরুনো বিজয় আহমেদের ছড়ার বই ‘লাল মোরগের ঝুটি’। বেশ বিক্রি হচ্ছে অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে আসা হামিম কামালের উপন্যাস ‘কারখানার বাঁশি’। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী মাধ্যমের লেখালেখিতেও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কথাশিল্পীরা। সেই সুবাদে ভাল চলছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে আসা সানজানা সাদিকের গল্পগ্রন্থ ‘টাইগার, টাইগার এ্যান্ড আদার শর্ট স্টোরিজ’ এবং জাভেদ জাহাঙ্গীরের উপন্যাস ‘ঘোস্ট এ্যালি’। উনিশতম দিনের মেলাচিত্র : সোমবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার উনিশতম দিন। বেলা ৩টায় খুলে যায় প্রবেশদ্বার। বসন্তের দুপুর গড়ানো বিকেলে বেড়েছে পাঠকের সংখ্যা। সন্ধ্যাবেলায় বইপ্রেমীদের ভরপুর সমাগম ঘটেছে মেলায়। অধিকাংশ প্যাভিলিয়ন থেকে শুরু করে স্টলে স্টলে চোখে পড়েছে পাঠকের ভিড়। সেই সুবাদে বইয়ের বিকিকিনিও হয়েছে। তাই প্রকাশকের চেহারায়ও ফুঠে উঠেছে সন্তুষ্টির চিত্র। কারণ ভরা যৌবনের মেলায় এখন দর্শনার্থীদের ঘোরাঘুরি কিংবা বই দেখাদেখির চেয়ে বিক্রিটাই হচ্ছে বেশি। বই কথন ॥ মেলার উনিশতম দিনে প্রকাশিত হয়েছে ১৪১টি নতুন বই। অনন্যা থেকে এসেছে শ্যামসুন্দর সিকদারের কাব্যগ্রন্থ ‘ছুঁয়ে দেখি অন্তরঙ্গতায়’। বেহুলা বাংলা থেকে এসেছে তরুণ লেখক তৌহিদুর রহমানের উপন্যাস ‘অলৌকিক বাঁশি’। বাংলা একাডেমি থেকে এসেছে আসাদ চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, শামসুজ্জামান খানের বঙ্গবঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নভিত্তিক ‘নানা বর্ণে নানা রেখায়’ এবং অনুপাম হায়াতের ‘বহুমাত্রিক নজরুল’। কামাল উদ্দিন সরকারের কাব্যগ্রন্থ ‘কাব্য ও কথা’ প্রকাশ করেছে মেঘনা পাবলিকেশন্স। মুস্তাফিজ শফির ‘মায়াবী সেই ভূতকন্যা’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। সুধাংশ শেখর রায়ের ‘সাংবাদিকতা, সাংবাদিক, সংবাদপত্র’ ও রাহাত মিনহাজের ‘প্রতিবেদন লেখার প্রথম পাঠ’ প্রকাশ করেছে পলল। শেখ আবদুল হাকিমের ‘১১টি নভেলা’ ও ‘সাতটি নভেলা’ প্রকাশ করেছে সালমা বুক ডিপো। মূর্ধণ্য থেকে বেরিয়ে মঈনুল হাসান ও মোজাফ্্ফর হোসেনের ‘কল্পে গল্পে ইলিশ’। অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে এসেছে হামিম কামালের ‘কারকানার বাঁশি’। ইমদাদুল হক মিলনের ‘রমাকান্ত ও সতেরোটি বাচ্চাকাচ্চা’ প্রকাশ করেছে অনন্যা। চন্দ্রদ্বীপ এনেছে আখতার হুসেনের ‘বাঘের ছানার নাম সোনালি’। কাওছার মাহমুদের ‘দুই পকেট হাসি’ এনেছে পাঞ্জেরী। আমীরুল ইসলামের ‘মায়ের জন্য ভালোবাসা’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। চিরদিন থেকে বেরিয়েছে অসীম সাহার ‘প্রতিশীল সাহিত্যের ধারা’। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এদিন প্রকাশিত ১৪১টি বইয়ের মধ্যে গল্প ২২, উপন্যাস ২৪, প্রবন্ধ ১১, কবিতা ৫৩, ছড়া ৩, শিশুতোষ ৩. জীবনী ২, মুক্তিযুদ্ধ ৩, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ২, রম্য ১, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের নতুন ১২টি বই এসেছে। মেলামঞ্চের আয়োজন : সোমবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, সেলিম জাহান এবং ফাহমিদা খাতুন। সভাপতিত্ব করেন হাসনাত আবদুল হাই। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় সামিউন জাহান দোলার একক অভিনীত ধ্রুপদী এ্যাক্টিং স্পেসের নাটক ‘নভেরা’। আজকের অনুষ্ঠানসূচি : আজ মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার কুড়িতম দিন। মেলার দ্বার খুলবে বেলা ৩টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস : বহুত্ববাদ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের চার রাষ্ট্রনীতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আকসাদুল আলম। আলোচনা করবেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মাহবুবুল হক।
×