ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে মামলাই একমাত্র পথ-২

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে মামলাই একমাত্র পথ-২

॥ পর্ব-দুই ॥ অনলাইন হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে আমেরিকার তিনটি মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক- দি ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, দি সিটি ব্যাংক এবং ওয়েলস ফারগো ব্যাংক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নিয়মকানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে যে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই বিধিবিধানগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হলে রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন ভুয়া হিসাবইবা খুলল কিভাবে এবং এই মানি লন্ডারিংয়ের চূড়ান্ত লেনদেন তাদের ব্যাংকে নিষ্পত্তিইবা হলো কিভাবে? আমরা মাত্র এক হাজার ডলার পাঠাতে গেলে এখানকার ব্যাংকগুলো হরেক রকম প্রশ্ন করে এবং অনেক ধরনের কাগজপত্র চেয়ে বসে অর্থের বৈধ উৎস নিশ্চিত করার জন্য। অথচ সেইসব ব্যাংকই বিনা বাক্যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অন্য একটি দেশের ব্যাংকের হিসাবে ক্রেডিট করে দিল কিভাবে- এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের এই তিনটি মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক ওই মানি লন্ডারিং ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং তারা এই মামলার পক্ষ হতে বাধ্য। ইউএস প্যাট্রিয়ট আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ইউএস প্যাট্রিয়ট আইন ২০০১ ও ইউএস ক্রিমিনাল মানি লন্ডারিং এ্যান্ড সিভিল ফরফিচার আইন ১৯৮৬- আইন দুটো মানি লন্ডারিং এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেন প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী অস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনার ক্ষেত্রে এই দুটো আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। ইউএস প্যাট্রিয়ট আইনের ৩১১ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, লেনদেনকারী ব্যাংক তাদের গ্রাহকের পরিচিতি নিশ্চিত করবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবে, যদি কোন লেনদেন বিদেশী কোন ব্যাংকের করেসপনডেন্ট হিসাবের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। আমেরিকার তিনটি ব্যাংক তাদের সঙ্গে পরিচালিত রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের করেসপনডেন্ট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ জমা করেছে। আইনের এই বিধান অনুযায়ী সেই ব্যাংকের পরিচিতি নিশ্চিত এবং লেনদেন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করলে এই লেনদেন যে ভুয়া তা ধরা পড়ার এবং এই অর্থ জমা করা থেকে বিরত থাকার কথা। একই আইনের ৩১২ ধারায় বলা আছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো তদের করেসপনডেন্ট হিসাব রক্ষাকারী বিদেশী ব্যাংকগুলোর ওপর ডিডি (ডিউ ডিলিজেন্স) এবং ইডিডি (এনহেন্সড ডিউ ডিলিজেন্স) প্রয়োগ করবে। এসব হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে, বিশেষ করে যেখানে করেসপনডেন্ট হিসাবের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং ঝুঁকি বিদ্যমান থাকে। আমেরিকার এই তিনটি ব্যাংক আইনের ৩১২ ধারাও লঙ্ঘন করেছে। কেননা এই ধারার যথাযথ প্রয়োগ হলে রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের করেসপনডেন্ট হিসাব আমেরিকার কোন ব্যাংকের সঙ্গে থাকারই কথা নয়। কেননা তারা সরাসরি এ রকম একটি নজিরবিহীন মানি লন্ডারিং ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়েছে। এই আইনের ৩১৯ ধারায় এমন ক্ষমতা দেয়া আছে যে, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণ হলে সেই দোষী ব্যাংকের করেসপনডেন্ট হিসাব থেকে সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেয়ার নির্দেশ সেখানকার ফেডারেল রিজার্ভ বা আদালত দিতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক অর্থ ফেরত তথা প্রদানের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তাই এই মামলাটি যথাযথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দায়ের করা গেলে ও বিজ্ঞ বিচারক যদি প্রমাণ পান এবং ঘটনার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নিশ্চিত হন তাহলে তিনি সম্পূর্ণ অর্থ ওই দোষী ব্যাংকের হিসাব থেকে নিয়ে নেয়ার সরাসরি নির্দেশ দিতে পারেন। ইউএস ক্রিমিনাল মানি লন্ডারিং এ্যান্ড সিভিল ফরফিচার আইন ১৯৮৬ তেমনি আরেকটি শক্তিশালী আইন, যা দিয়ে মানি লন্ডারিং এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেন প্রতিরোধ করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কিছু আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যার মধ্যে অর্থ স্থানান্তর জালিয়াতি বা ওয়ার (অর্থ স্থানান্তর) ফ্রড অন্যতম। এই আইন বিদেশী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে, যদি কোন লেনদেন আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত হয় অথবা সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের কোন ব্যাংকে হিসাব পরিচালনা করে। সুতরাং, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই আইনটি সরাসরি লঙ্ঘিত হয়েছে। কারণ প্রথমত এটি একটি ওয়ার (অর্থ স্থানান্তর) ফ্রড, দ্বিতীয়ত এই ওয়ার ট্র্যান্সফার সংঘটিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে। তৃতীয়ত এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে হিসাব পরিচালনা করে। সুতরাং, এই আইনের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির সুবিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেই বাংলাদেশ ব্যাংক এদিকে অগ্রসর হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আইনজীবী নিয়োগ কোন আইনী লড়াই ভালভাবে চালিয়ে যেতে এবং এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সুবিচার পেতে হলে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে যে সকল অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে একাধিক দেশ ও দেশের প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে সেখানে অভিজ্ঞ আইনজীবীর ভূমিকা অপরিহার্য। উত্তর আমেরিকায় বিশেষ করে আমেরিকায় আইনী খরচ মাত্রাতিরিক্ত। তাই এখানে দুটো পদ্ধতিতে আইনী সহযোগিতা গ্রহণের প্রচলন আছে। এখানে সরাসরি আইনজীবী নিয়োগ করা যায় যিনি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মামলাটি পরিচালনা করেন। এভাবে আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো যে, মামলার হারজিত যাই হোক না কেন আইনজীবীর সম্মানী যথারীতি পরিশোধ করতে হয়, যা সাধারণত কয়েক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর বিকল্প হিসেবে আইনজীবীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব আইনজীবীর ওপর ন্যস্ত করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আইনজীবীকে পৃথক কোন সম্মানী প্রদানের প্রয়োজন হয় না মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত। তবে চুক্তিতে শর্ত থাকে যে, বাদীপক্ষ মামলায় জিতলে এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় হলে সেখান থেকে উল্লেখিত হারে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আইনজীবী কেটে রাখবে তার সম্মানী হিসেবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আদালতের রায়েও বিষয়টির উল্লেখ থাকে। উত্তর আমেরিকায় বিশেষ করে যে সমস্ত মামলায় আর্থিক ক্ষতি পূরণের বিষয়টি জড়িত থাকে সেখানে এই পদ্ধতিতে আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা খুবই জনপ্রিয় একটি ব্যবস্থা। কেননা এতে বাদীপক্ষ হেরে গেলে তাকে কোন আইনী খরচ বহন করতে হয় না। সাধারণত আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট মামলার নথিপত্র ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে যখন বুঝতে সক্ষম হন যে, এই মামলায় জিতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের সমূহ সম্ভাবনা আছে, তখনই তারা এইভাবে চুক্তিভিত্তিক মামলা পরিচালনায় সম্মত হয়ে থাকেন। এ রকম একটি আর্থিক জালিয়াতির বিষয়ে আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হলে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের সহযোগিতা করার বা তাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য আমাদের দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের সহযোগিতারও যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। আমার জানামতে আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক আইনে পারদর্শী অনেক খ্যাতিমান আইনজীবী আছেন যাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ও সুনাম আন্তর্জাতিক মানের। তাদের দু’একজনের সমন্বয়ে একটি আইনজীবী প্যানেল তৈরি করা যেতে পারে, যাদের একমাত্র কাজ হবে এই মামলা পরিচালনার জন্য বিদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আমেরিকা-কানাডার ব্যাংকে কমপ্লায়েন্স বিভাগে প্রত্যক্ষ কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে এই আইনজীবী প্যানেলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কেননা তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স, কেওয়াইসি (নো ইউর কাস্টোমার) এবং কেওয়াইসিসি (নো ইউর কাস্টোমারস কাস্টোমার), ডিডি (ডিউ ডিলিজেন্স), ইডিডি (এনহেন্সড ডিউ ডিলিজেন্স) প্রভৃতি বিষয়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে সহযোগিতা করতে পারবে। আমার ধারণা, অনেক সিনিয়র এবং অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশী ব্যাংকার আছেন যাদের আমেরিকা-কানাডার বৃহৎ ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স বিভাগে কাজের বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাদের সহযোগিতা অবশ্যই এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মামলার স্থান বিশ্বে অবৈধ লেনদেনের অর্থ উদ্ধারের অসংখ্য নজির আছে। তাছাড়া এই ডলার অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া হয়নি। এগুলো এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছে, যার বিপরীতে সমপরিমাণ মূল্যের স্থানীয় মুদ্রার লেনদেন হয়েছে ফিলিপিন্সে। এই জালিয়াতির সঙ্গে ফিলিপিন্সের যারা বা যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত তারা নিজেরাই এই দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছে। এই মানি লন্ডারিং ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন তাদের কয়েকজন অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এমনকি এই ব্যাংক তাদের তৎকালীন প্রধান নির্বাহীকেও এই অভিযোগে সরিয়ে দিয়েছে। এগুলোই তো বড় প্রমাণ যে, ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন এই অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাই তারা এই অর্থ এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে বাধ্য। যেহেতু এই অপরাধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সংঘটিত হয়েছে ফিলিপিন্সে ও ফিলিপিন্সের রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন এবং বেশ কয়েকটি পক্ষ এতে জড়িত, তাই ফিলিপিন্সের আদালতেই এই মামলা দায়েরের একটি উপযুক্ত স্থান। পক্ষান্তরে, যেহেতু এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং ইউএস প্যাট্রিয়ট আইন ২০০১ ও ইউএস ক্রিমিনাল মানি লন্ডারিং এ্যান্ড সিভিল ফরফিচার আইন ১৯৮৬ -এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে, তাই এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেও মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক তার খোয়া যাওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারসহ প্রত্যাশিত প্রতিকার আদায় করতে পারে। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×