ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরপাড়ের বিবর্ণ মাঠে সবুজের আস্তরণ

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সাগরপাড়ের বিবর্ণ মাঠে সবুজের আস্তরণ

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া ॥ সাগরপাড়ের কলাপাড়ায় এবছরে যেন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে আমন কাটার পরের দৃশ্য। অনাবাদি, ধুষর, বিবর্ণ মাঠের মধ্যেই আবার সবুজের আস্তরণ। যেখানেই মিঠা পানির আধার রয়েছে, সেখানেই বোরোর আবাদ করছেন কৃষক। যেন কোমর বেঁেধ নেমেছেন বোরোর আবাদে। এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে বোরো চাষের। এমনকি শেষকালে সেচের সঙ্কটের শঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। যেখানে গেল বছর (২০১৭) কলাপাড়ায় মাত্র ৫১৮ একর জমিতে বোরোর আবাদ করেছিল কৃষক। সেখানে এবছর সোমবার পর্যন্ত দেয়া হিসেবে কৃষি অফিসের তথ্যমতে বোরোর রোপন করা হয়েছে ছয় হাজার এক শ ৩৫ একর জমি। সরেজমিনে গেলে দেখা যায় কৃষকের বোরোর আবাদের নিরন্তর চেষ্টা। এবছর প্রথম যৌথভাবে বোরোর আবাদ করছেন কৃষক মোশাররফ হোসেন মোল্লা, মোশাররফ শিকদার, ফারুক শিকদার ও সুনীল বিশ^াস। ২৪ বিঘা জমিতে বোরোর চারা রোপনে ব্যস্ত নিজেরাসহ কামলা নিয়ে। ইসলামপুর গ্রামের এই চাষীদের বিশ^াস প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকি কম থাকায় তারা বোরোর আবাদে নেমেছেন। কানি জমিতে (আট বিঘা) প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ রয়েছে বলে জানান, মোশাররফ মোল্লা। চাষাবাদ, সার-কীটনাশক, রোপন ও সেচ নিয়ে এ পরিমাণ খরচ হয়েছে তাদের। রাজকুমার জাতের ধানের চারা রোপন করছেন। এ যাবতকাল অনাবাদী থাকা এ জমিতে একাধিক ফলনের লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছেন এই চার চাষী। এলেমপুর গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল কেউ আবাদ করছেন। কেউ বীজতলা থেকে চালা তুলছেন। কেউবা আবার রোপনে ব্যস্ত। সার ছিটাচ্ছেন কেউ কেউ। এদের একজন হানিফ সরদার। ৫০ শতক জমিতে বোরোর আবাদের লক্ষ্যে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করাচ্ছেন। আর নিজে গোবর সার ছিটাচ্ছেন। জানালেন, চার কেজি ধানের বীজ করেছেন। জানা গেল, ওই গ্রামের ফরিদ কেরানী ১২ বিঘা, জসিম কেরানী আট বিঘা, সোহেল ১২ বিঘা, বশির হাওলাদার চার বিঘা, আবুল চৌকিদার দুই বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করছেন। গিয়াস উদ্দিন জানালেন, দুই লাখ টাকায় আট বিঘা জমি কট কওলা রেখে এখন আমনের পরে বোরোর আবাদ করেছেন। সবজির ক্ষেত থেকে তরতাজা গাড়ো সবুজ তিনটি লাউ ও কিছু শালগম কেটে মাথার ঝুড়িতে করে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আব্দুর রব গাজী। বয়োবৃদ্ধ মানুষটি জানালেন, উবাইর্যার খালে পানি বেশি। তাই দুই পাড়ে বোরোর আবাদ বেশি হয়েছে। রোপনের ক্ষেত আবাদের জন্য সেচের নালা কাটছিলেন শামসুল হক। জানালেন ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি দরে রাজকুমার ও ময়না জাতের ধানবীজ কিনে বীজতলা করেছেন। এখন রোপনের ক্ষেত তৈরি করছেন। এভাবে নীলগঞ্জের গামইরতলা, কুমিরমারা, মজিদপুর, পাখিমারা, ছলিমপুর, নীলগঞ্জ, নবাবগঞ্জসহ সব গ্রামেই কমবেশি কয়েকশ’ চাষী ভীষণ ব্যস্ত রয়েছেন বোরোর আবাদে। খালের পাড়ে। পানি শুকানো পুকুরের তলদেশে। বাড়ির পাশে। যে যেখানেই পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই কৃষক বোরোর আবাদের জন্য করেছেন বীজতলা কিংবা রোপনের ক্ষেত। তবে কৃষকের ক্ষোভও রয়েছে। নীলগঞ্জের নিজকাটার স্লুইস ভেঙ্গে যাওয়ায় লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে নিজেরা চাঁদা তুলে বাঁধ দিয়েছেন অভ্যন্তরের খালে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ থেকে কোন আর্থিক সহায়তা করা হয়নি। এখনও অন্তত কুড়ি হাজার টাকার দেনা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন কৃষক আবুল কালাম। তারা এ পরিমাণ সহায়তা চেয়েছেন। উত্তরাঞ্চলের জনপদের এসময়ের এই চিত্র স্বাভাবিক হলেও দক্ষিণের সাগরপাড়ের কলাপাড়ার জনপদের এ বছরের এই দৃশ্যপট আলাদা বৈচিত্র এনে দিয়েছে। কৃষকের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বোরোর আবাদে। তারা যেন কোমর বেধে বোরোর আবাদে নেমেছেন। সবজির পাশাপাশি বোরোর আবাদ এবছর এই জনপদে লক্ষনীয় বিষয় হিসেবে চোখে ধরা পড়ছে। এ বছর আমনের ভাল দাম পাওয়া। সবজির চড়া দাম থাকায় বোরোর আবাদে কৃষকের আগ্রহ একটু বেশি। ১২ ইউনিয়নের সর্বত্রই এ বছর বোরোর কমবেশি আবাদ হলেও কৃষি বিভাগের মতে, নীলগঞ্জ, ধুলাসার, ধানখালী, লতাচাপলীতে একটু বেশি আবাদ হচ্ছে বোরোর। অন্তত ১১ হাজার কৃষক এই বোরোর আবাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলেও কৃষি বিভাগের দাবি। উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মোঃ মসিউর রহমান জানান, এ বছর কলাপাড়ায় কৃষকরা অন্তত ১১ হাজার মেট্রিক টন বোরোর ফলন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। মোট কথা কলাপাড়ার এই মৌসুমে বিবর্ণ আমন ক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বোরো আবাদের সবুজ আস্তরণ। যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কুষকরাও রয়েছেন স্বস্তিতে। তবে লতাচাপলীর কৃষক মোঃ আক্কাছ উদ্দিন জানালেন, তার ২১ একর জমির আবাদ করা বোরোর ক্ষেতে সেচ সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এজন্য যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি মিঠা পানির খাল জবরদখল করে রেখেছে। তাদের দখলমুক্ত করে খাল থেকে কৃষককে সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি প্রয়োজন।
×