ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাবিহা রহমান

চেতনায় একুশ

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

চেতনায় একুশ

একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহঙ্কার। প্রতিবছর একুশ আসে বাঙালীর চেতনা ও শিল্পসত্তাকে নতুন করে আরেকবার শাণিয়ে দিতে। একুশের এই চেতনাকে হৃদয়ে লালন, বাঙালীর শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে মোটকথা জীবন যাপনে এর প্রভাব নিয়ে আমাদের আয়োজন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমর অধ্যায়। এ দিনটি আমাদের বেদনার কণকপদ্ম, চেতনার অগ্নিমশাল। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতীয় জীবনকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য অমর একুশের সীমাহীন অবদানের কথা তাই ভোলার নয়। একুশ আমাদের দেশ ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা। আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য, আত্মসচেতন হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে মহান একুশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ যে দুর্বার সাহসের পরিচয় দিয়েছিল এবং অগণিত জীবন উৎসর্গ করেছিল, তার প্রেরণা এসেছিল একুশের চেতনা থেকেই। ভাষা আন্দোলনের শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদেও এখন তৈরি করা হচ্ছে শহীদ মিনার। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিসের অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং পরের বছর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশ। বাঙালী জাতিসত্তার অনুপ্রেরণা ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান থেকে শুরু করে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুই একুশের অনুপ্রেরণায় পাওয়া। আমাদের এই শক্তিকে ভুলে গেলে চলবে না। একুশের চেতনা আমাদের চলার পথের পাথেয়। প্রতিটি প্রজন্মকেই এই চেতনা বুকের মাঝে লালন করতে হবে। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, ফ্যাশনÑ আমাদের প্রতিটি শৈল্পিক ভাবনায় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রাণাবেগকে করে তোলে বেদনাপ্লুত। ভাষার প্রতি বাঙালীর শিকড়ের যে টান তা প্রকাশ পায় বাঙালীর লেখায়, রেখায় ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে। একুশের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ নানা অঙ্গন। প্রতিবছর বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের গ্রন্থমেলা আজ বাঙালীর প্রাণের মেলারূপে বাঙালীর হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ বলেন, ‘একুশ যতটুকু আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে আমার মনে হয় ততটুকু আমরা আমাদের কর্ম, কথায়, চলনে ফুটিয়ে তুলছি না। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ি একুশ নিয়ে অনুষ্ঠান করতে, একুশের গান বাজাতে, পোশাক পরতে। অথচ বাকি সময় আমরা একুশের প্রতি থাকি অনেকটাই উদাসীন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে অতি যতেœ ফুল দিলেও সারা বছর তা পড়ে থাকে অবহেলায়, অযতেœ। এটা দুঃখজনক। সারাবছরই আমাদের একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে। একুশ হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আমাদের কাজে-কর্মে, সম্মান-শ্রদ্ধায় তা প্রকাশ করতে হবে।’ একুশের ইতিহাস এ প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাছে কতটুকু স্বচ্ছ জানতে চাইলে আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী কণিকা রহমান শুভ্রা বলে, ‘সালাম-বরকতদের প্রাণের বিনিময়ে একুশ পেয়েছি। একুশ এলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে হয় আমরা অধিকাংশ এতটুকুই জানি। কিন্তু প্রাণ দেওয়ার পেছনে কী ইতিহাস তা আমরা সেভাবে জানি না। আর যদি আমরা আসল ইতিহাসই না জানি তবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে কী করে। বাবা-মায়েরা, শিক্ষকরা আমাদের কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেন না। বইও অনেক সময় আমাদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ায়। কারণ একেক বইয়ে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো আমরা একেকভাবে পাই।’ তাই একুশের সঠিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আজকের প্রজন্মকে আরও বেশি বেশি একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে উৎসাহী করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের রয়েছে ভাষা আন্দোলনের মতো অধ্যায়। আমাদের ভাষায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো লেখক, যা পৃথিবীর আর কোন জাতির নেই। তাই একুশের চেতনায়, ভাষা আন্দোলনের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। এখন বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছে বিশ^বাসীও, যা একুশের ইতিহাসকে যেমন গৌরবময় করে তুলেছে- তেমন পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাকে তার নিজস্ব মহিমায় অধিষ্ঠিত করেছে। একুশ বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের প্রথম ভিত। কাজেই একুশের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনে ধরে রাখতে হবে। জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে একুশের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। ছবি : কে ক্রাফট
×