ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

পাঠাগারের জন্য তালিকা ধরে বই সংগ্রহ, নীরব কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

পাঠাগারের জন্য তালিকা ধরে বই সংগ্রহ, নীরব কেনাকাটা

ভিড় একটু কমেছে। রবিবার বিকেলে মেলায় ঢুকে মনে হলো, গত কয়েকদিনের তুলনায় লোক সমাগম কম। শুক্র ও শনিবার অনেকেই ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। বন্ধের দুই দিন তারা এসেছিলেন মেলায়। ভিড় বাড়াতে সহায়তাও করেছেন বৈকি! ১৮তম দিনে এসে দেখা গেল স্বাভাবিক উপস্থিতি। শাহবাগ থেকে টিএসসি হয়ে মেলায় প্রবেশ করার জন্য যে দীর্ঘ লাইন, যে লম্বা লেজটি; কাটা পড়েছে হঠাৎ। ফলে খুব সহজেই প্রবেশ করা গেল মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। কারও পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানোরও প্রয়োজন হলো না। মেলায় ঢুকে পাওয়া গেল ফাঁকা জায়াগাও। স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন ‘উঠোনটি’ অনেকদিন পর দৃশ্যমান হলো। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের জন্য যে মঞ্চ, সেটির সামনেও চিরচেনা হৈ চৈ পাওয়া গেল না। তবে কি ভাঙ্গা হাট হয়ে গেল মেলা? না। একদমই তা নয়। বরং মেলা ঘুরে মেলার যারা মূল মানুষ, তাদের পাওয়া হলো। এই মানুষেরা সংখ্যায় কম হলেও, প্রচুর বই কিনছিলেন। যারা সারাবছরই বই পড়েন, ভাল বই কী এসেছে খোঁজখবর রাখেন তারা স্থির হননি কোথাও। আবার অস্থিরতাও দেখা যায়নি। বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ বাড়াতে ছোট বড় সব স্টলে ঢুঁ মারছিলেন। নতুন বা কম পরিচিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোরও আছে ভাল প্রকাশনা। সেগুলো খুঁজে নিতে দেখা যাচ্ছিল। অনেকের হাতেই নতুন বইয়ের তালিকা। বিপুল সম্ভার থেকে কোন কোন বই সংগ্রহ করবেন, সাদা কাগজে লিখে নিয়ে এসেছিলেন তারা। কারও কারও হাতে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বইয়ের পূর্ণাঙ্গ তালিকা। পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত তালিকা দেখে প্রয়োজনীয় বই কিনছিলেন। ব্যাগ ভর্তি করে কিনছিলেন। দেখে বোঝার বাকি থাকে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠাগার সমিতি সংঘগুলোর পক্ষ থেকে বই কেনা চলছে। সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা এসেছেন মেলায়। আরিফুল ইসলাম ও শামসুল হক এসেছিলেন কুষ্টিয়া থেকে। দুজনের হাতে কয়েকটি ব্যাগ। বইয়ে ভর্তি। আরিফুল জানালেন, নিজ জেলায় একটি পাঠাগার গড়েছেন তারা। সেটির জন্য বই কিনতে এসেছেন। আগে একদিন এসে নতুন বইয়ের তালিকা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ এসেছেন কিনতে। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা মৌলিক গ্রন্থ তাদের প্রথম পছন্দ। এর বাইরে অনুবাদের কিছু বই কিনেছেন। মেলায় আসা সেরা বইগুলো যতটুকু সম্ভব জেনে বুঝে কেনার চেষ্টা করেছেন বলে জানান সঙ্গে থাকা শামসুল হক। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও বই কেনার সুযোগ আছে। বিশেষ করে যাদের পাঠাগার আছে তারা প্রতিবছর মেলা থেকে নতুন বই সংগ্রহ করেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় জাদুঘরের কথা বলা যেতে পারে। এদিন জাদুঘরের পাঠাগারের জন্য বই কিনতে এসেছিলেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি তিনি। জাদঘুরের আরেক কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখে বই কিনেন তিনি। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে হাশেম খান বলেন, বইমেলা তো বইয়ের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। মেলায় আসা নতুন বইয়ের তালিকা আগেই আমরা সংগ্রহ করেছিলাম। সে অনুযায়ী আজ কিছু বই কেনা হলো। আরও বই কেনা হবে বলে জানান তিনি। এভাবে বোঝা হয়ে যায়, দর্শনার্থী সংখ্যা কমলেও বইয়ের বিক্রি কমেনি। প্রকাশকরাও স্বীকার করে বললেন, মেলার শেষ সময়ে এসে বই সংগ্রহে বিশেষ মনোযোগী হয়েছেন পাঠক। বিশেষ দিনগুলোতে বহু মানুষের উপস্থিতিতে যে পরিমাণ বই বিক্রি হয়, এখন তার চেয়ে কম হচ্ছে না মোটেও। অর্থাৎ মেলায় আসা মানুষের মধ্যে ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। মেলায় কথা হয় আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনির সঙ্গে। তিনি বলেন, অযথা ঝামেলাটা এখন কমে গেছে। মূল ক্রেতারা সময় নিয়ে বই দেখছেন। কিনছেন। সামনের দিনগুলোতে বইয়ের মূল মানুষেরা আরও বেশি আসবেন এবং বই কিনবেন বলে আশা প্রকাশ করেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নেতা। ১৩৩ নতুন বই ॥ মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ১৩৩টি। নির্বাচিত বই ॥ হাসান আজিজুল হকের দিনপঞ্জি ‘আমার যেদিন গেছে ভেসে’ প্রকাশ করেছে ইত্যাদি। মঈনুল আহসান সাবেরের বই ‘বাবর আজমের উপন্যাস’ এসেছে পাঞ্জেরী থেকে। মেলায় এসেছে অনন্ত মাহফুজের অনুবাদ ‘সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তদের ছোটগল্প।’ সুবর্ণ থেকে এসেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনা ‘মুক্তিযুদ্ধের কথকতা।’ লেখক সত্যজিৎ রায় মজুমদার। সাংবাদিক রাজু আহমেদের বই ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও দারিদ্র্যবিমোচন।’ প্রকাশ করেছে পালক পাবলিশার্স। উন্নয়ন ও অর্থনীতি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা ১২টি গবেষণা প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধের সংকলন। একটু সহজ করে লেখা। লেখাগুলো ভবিষ্যতে আরও গবেষণার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তচিন্তা থেকে মেলায় এসেছে উপন্যাস ‘বিরহজোছনা।’ লেখক ইভান অনিরুদ্ধ। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক। নতুনের স্বাদ পাবেন পাঠক। ঈশিতা আজাদের কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন ॥ আগেই বলে নেয়া ভাল, ঈশিতা আজাদ কবি শামীম আজাদের মেয়ে। প্রবাসী কবি হিসেবে মায়ের বেশ পরিচিতি। এবার একই পরিচয়ে সামনে এলেন মেয়ে। বিলেতে বড় হওয়া। বেড়ে ওঠা। ইংরেজীটা ভাল রপ্ত করেছেন। সে ভাষাতেই কবিতা। তবে ভেতরে যে বাঙালিত্বের বোধ, শাড়ি পরা মেয়েকে দেখে বেশ বোঝা যায়। এই প্রজন্মের মেয়ে বাইরের চাকচিক্য ভুলে দেশে এসে কাজ করছেন। এমন উন্নত চেতনার মেয়েই তো কবিতা লিখবেন। লিখেছেনও। তার কবিতার বই ‘ELEGIAC SONGS’ প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান। কয়েকদিন আগেই মেলায় এসেছিল। আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হলো রবিবার। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ছোট কিন্তু সুন্দর একটি আয়োজন। আগামীর কবিকে শুভ কামনা জানাতে এসেছিলেন কানাডা প্রবাসী কবি ফেরদৌস নাহার, সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ.ম. হারুন প্রমুখ। মেয়ের বন্ধুরা এসেছিলেন। এক পর্যায়ে যোগ দেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। সবাই মিলে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। বক্তারা বলেন, ঈশিতার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান আজ হলেও তার কবিতার চর্চা শুরু হয়েছিল আরও আগে। ভেতরে ভেতরে নিজেকে তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। নবীন কবি বাংলা এবং ইংরেজী দু’ভাষাতেই পারদর্শী। মাতৃভাষার ভিতটা মজবুত। এ কারণে দেশে এবং দেশের বাইরের পাঠকের কাছে তিনি সহজেই পৌঁছতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বক্তারা। তবে কবি ও কবিমাতা শামীম আজাদ তেমন কিছুই বলতে পারেননি। বারবার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরছিলেন। কপালে চুমু খাচ্ছিলেন। চোখে টলমল করছিল জল। এই জল এই আনন্দ অশ্রু, আহা কত কথা যে বলে গেল! মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ এদিন গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ ॥ মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী ॥ এ কে নাজমুল করিম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, মীজানুর রহমান শেলী এবং সোনিয়া নিশাত আমিন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ, মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, এ কে নাজমুল করিম- এই তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বাঙালী মুসলমানের সমাজবিকাশের ধারাকে তাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং একই সঙ্গে প্রায়োগিক দিশা প্রদানের কাজটিও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×