ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন রাঙ্গুনিয়ার সাবেক এমপি ইউসুফ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 চলে গেলেন রাঙ্গুনিয়ার সাবেক এমপি ইউসুফ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ জীবন সায়াহ্নে গুরুতর অসুস্থ থাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সেই নিঃস্ব সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং এক সময়ের তুখোড় বাম রাজনীতিক মোহাম্মদ ইউসুফ আর নেই। রবিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি....রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। অকৃতদার এই ত্যাগী নেতা দুই ভাই, দুই বোন এবং অনেক আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। রবিবার বিকেলে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং সংসদ সদস্যগণ। এরপর সড়ক পথে রাতের মধ্যে মরদেহ নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। আজ সোমবার বাদ জোহর রাঙ্গুনিয়া হাইস্কুল মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে। আন্দোলন সংগ্রাম ও শ্রমিক রাজনীতির অগ্রসৈনিক মোহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের রাজনীতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকপ্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশররফ হোসেন, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রাঙ্গুনীয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম, চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। তারা মোহাম্মদ ইউসুফের ত্যাগ ও সততার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। উল্লেখ্য, শেষ জীবনে এসে চরম আর্থিক দৈন্যতায় চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মোঃ ইউসুফ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল ঝড় উঠলে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারই নির্দেশে গত ৭ জানুয়ারি এই নেতাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ৯ জানুয়ারি বিকেলে তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎধীন অবস্থায় ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সাবেক সম্পাদকম-লীর সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে ৮ দলীয় জোটের হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর ভাই এনডিপির প্রার্থী গিয়াস কাদের চৌধুরী। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মোহাম্মদ ইউসুফ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ছিল না তার আর্থিক সঙ্গতি। বার্ধক্যে উপনীত মানুষটি নানা রোগে ভুগলেও অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও দলের সাবেক একজন সংসদ সদস্যের টাকার অভাবে চিকিৎসা না পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় ওঠে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দেন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন রাঙ্গুনিয়ায় মোহাম্মদ ইউসুফের গ্রামের বাড়িতে যান। তাকে এনে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। ৯ জানুয়ারি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫০ সালে রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও মা মরিয়ম বেগম। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা যান। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সে সংসারে তার আরও দুই ভাই ও তিন বোনের ভালবাসা তাকে সিক্ত করে। মরিয়মনগর আলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মরিয়মনগর উচ্চবিদ্যালয়ে ২ বছর শিক্ষা গ্রহণের পর ভর্তি হন রাঙ্গুনিয়া আদর্শ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। রাঙ্গুনিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হন এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। তিনি রাঙ্গুনিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এই মুক্তিযোদ্ধার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী পাটকলে চাকরিতে যোগ দেয়ার মধ্যে দিয়ে। ওই সময় থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত একটানা ২০ বছর শ্রমিক নেতা হিসেবে কাজ করে গেছেন জনকল্যাণে। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর শুধুই কাজ করেছেন রাঙ্গুনিয়ার মানুষের কল্যাণে। নিজের আর্থিক ভিত্তি গড়ার চেষ্টা করেননি। রাঙ্গুনিয়ার উন্নয়ন আর শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ ইউসুফের নিজের সংসারও করা হয়ে ওঠেনি। ২০০১ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্তের পর থেকে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৭ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ইউসুফের শরীরের একাংশ অবশ হয়ে যায়। এরপর বিছানা থেকে নামতেও পারতেন না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। মুক্তিযোদ্ধার মাসিক সম্মানী ভাতা আর ছোটভাই সেকান্দরের চায়ের দোকানের আয়ে কিছুতেই ভাল চিকিৎসা চলছিল না।
×