ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহে জৌলুস হারাচ্ছে নামী স্কুলগুলো

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ময়মনসিংহে জৌলুস হারাচ্ছে নামী স্কুলগুলো

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ মেধাবী ও ভাল মানের কোন শিক্ষার্থী পাচ্ছে না ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী নামীদামী স্কুলগুলো। এর প্রভাব পড়ছে এসএসসি ফলাফলের ওপর। গত তিন দশকে মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাবে নগরীর বেশিরভাগ নামীদামী ও খ্যাতিমান স্কুল এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নামীদামী স্কুলগুলোর এমন বিপর্যয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় শিক্ষাবিদরা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে মনগড়া পাঠদান, স্কুল পরিচালনায় স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ও শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি আর কোন্দলসহ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় এমন মরণদশায় পৌঁছেছে স্কুলগুলো। আর এই সুযোগে রাতারাতি ভাড়া করা বাসাবাড়িতে গজিয়ে উঠেছে অনুমোদনহীন অসংখ্য ভুইঁফোড় বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারী বরাদ্দের বই প্রদানসহ নানাভাবে এসব অনুমোদন বিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নামকরা স্কুলের একশ্রেণীর শিক্ষক মদদ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ নামকরা স্কুলগুলোর নিজস্ব ভৌত অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিক্ষক ম-লী ও মাল্টিমিডিয়ার ক্লাসের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তারপরও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় জৌলুস হারাচ্ছে এক সময়কার নামকরা স্কুলগুলো। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ঐতিহ্য হারাতে বসা নগরীর নামীদামী স্কুলগুলোর তালিকায় রয়েছে সিটি কলেজিয়েট স্কুল, মৃত্যুঞ্জয় স্কুল, এ্যাডওয়ার্ড ইনস্টিটিউট, নাসিরাবাদ কলেজিয়েট স্কুল, রাধা সুন্দরী গার্লস স্কুল, মুসলিম গার্লস হাই স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল, প্রবাহ বিদ্যা নিকেতন, কুমার উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল ও ময়মনসিংহ উচ্চ বিদ্যালয়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম র‌্যাংলার আনন্দ মোহন বসুর পৈত্রিক ভিটার প্রায় এক একর জমিতে ময়মনসিংহ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সিটি কলেজিয়েট স্কুল। ক্যালকাটা সিটি কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজের বাইরে এই শাখার প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন গিরিশ চন্দ্র চক্রবর্তী। প্রতিষ্ঠা লগ্নে এর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কত ছিল জানা না গেলেও আশির দশক পর্যন্ত ময়মনসিংহ নগরীর নামকরা এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ও ফলাফল ছিল অভাবনীয়-এমন দাবি স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক নুরুল ইসলামের। মাত্র ৩ দশকের ব্যবধানে প্রায় ১৫শ’ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমে এখন ৩০০ থেকে ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সেরা নামকরা স্কুলের একটি ছিল মৃত্যুঞ্জয় স্কুল। অনাথ বন্ধু গুহ তার বাবা মৃতুঞ্জয় গুহের নামে ১৯০১ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। অমিয় ভূষণ গাঙ্গুলী ছিলেন এর প্রথম প্রধান শিক্ষক। খ্যাতিমান শিক্ষকদের পাঠদানে কড়াকড়ি চরিত্রের এই স্কুলটিতে আশির দশক পর্যন্ত ছাত্র সংখ্যা এবং ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয় অবস্থানে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দুই থেকে তিন হাজার ছাত্র সংখ্যার এই স্কুলে এখন ৩০০ থেকে ৪০০ ছাত্র অধ্যয়ন করছে। আর এসএসসিতে অংশ নিচ্ছে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ ছাত্র! গত ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ৪৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করে মাত্র ৩৪ জন। গত ২০১৫ সালে ৩৩ জনের মধ্যে পাস করে ২৪ জন। এই দুই বছরে কোন ছাত্র জিপিএ ফাইভ পায়নি। এমন বিপর্যের কারণ হিসেবে স্কুলের একাধিক শিক্ষকের যুক্তি হচ্ছে- স্থানীয় বিদ্যাময়ী, জিলা ও গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরীর মতো সরকারী স্কুলগুলোতে দুটি শিফট চালুসহ স্কুলের চারপাশে আধুনিক মানের ও ডিজিটাল চরিত্রের বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সচেতন পরিবারের সন্তানদের এই স্কুলে ভর্তি করছেন না কোন অভিভাবক। ফলে মেধাবী ও মানসম্পন্ন কোন ছাত্র পাচ্ছেন না তারা। হতদরিদ্র ও নি¤œবিত্ত পরিবারের যেসব ছাত্রকে ভর্তি করা হচ্ছে- তাদের পাস করানোই দায় হয়ে পড়েছে শিক্ষকদের। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না স্কুলটি। স্থানীয় অভিভাবকদের অভিযোগ-বয়সের ভারে ন্যুব্জ প্রবীণ শিক্ষকদের পাঠদানে অনীহার কারণেই ছাত্র হারায় স্কুলটি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে নগরীর প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত নামকরা রাধা সুন্দরী ও প্রবাহ বিদ্যা নিকেতন। প্রায় এক একর জমিতে ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পুরনো রাধা সুন্দরী স্কুল এখন প্রায় ছাত্রী শূন্য বললেই চলে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত চালু স্কুলটিতে বর্তমানে ১৫০ ছাত্রী থাকার কথা বলা হলেও উপস্থিতির হার অর্ধেকের চেয়েও কম বলে জানা গেছে। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় ২৫ জন এবং গেলবার ২২ জন অংশ নিয়েছিল। এসএসসিতে ফলাফল কেমন? প্রশ্নে বিব্রত শিক্ষকরা সোজাসাপ্টা জবাব দিতে চাননি। প্রবাহ বিদ্যা নিকেতনের অবস্থা আরও করুণ। এসব স্কুল প্রধানরা একই সুরে জানিয়েছেন, হতদরিদ্র ও নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান ছাড়া কোন ছাত্র পাচ্ছে না তারা। এসব ছাত্রদের যেখানে পাস করানোই দায় সেখানে ভাল ফল মিলবে কীভাবে-এমন প্রশ্ন রেখেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানরা।
×