ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এখন রাত ১০-১২টা পর্যন্ত দোকান চলে

গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের আলো ॥ বেড়েছে কর্মঘণ্টা

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের আলো ॥ বেড়েছে কর্মঘণ্টা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ১৭ ফেব্রুয়ারি ॥ এখনও বর্ষায় স্যান্ডেল হাতে নিয়ে চলতে হয়। কাঁচা মাটির রাস্তা। পেছনে পড়ে থাকা গ্রাম খাপড়াভাঙ্গায় বসবাস মনিরুজ্জামানের। বয়স ৩৮ বছর। ভাবতেও পারেননি বাড়িতে এত আগেই বিদ্যুতের সংযোগ পেয়ে যাবেন। প্রায় এক বছর আগে বিদ্যুত সংযোগ পেয়েছেন। ব্যবহারের তিনটি হারিকেন এখন জাদুঘরের মতো ঘরের বেড়ার সঙ্গে স্থান পেয়েছে। জং ধরে গেছে। কবে জ¦ালিয়েছেন তা জানেন না। সোলার প্যানেলও জ¦ালাতে হয়না। এখন আর লোডশেডিং নেই। আর কুপি বাতি (ল্যাম্প) তো হারিয়ে গেছে। যেন, মেঘ না চাইতেই জল পাওয়া। জানালেন, গ্রামের ধনী-গরিব ৯০ ভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পেয়েছেন। নানা মোজাম্মেল হোসেন প্রায় এক শ’ বছর আগে বসতি গেড়েছেন এই জনপদে। তিনি ইহকাল ছেড়েছেন। এখন তৃতীয় প্রজন্ম হয়ে মনিরুজ্জামানের সংসারে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি। বাবলাতলা বাজারের খাবার হোটেলের মালিক ফারুক হোসেন। জানালেন, প্রায় তিন বছর আগে বিদ্যুত পেয়েছেন। স্বপ্নেও ভাবেননি তারা এত আগে বিদ্যুত পাবেন। চায়ের দোকানি মজনু জানান, ২৫ বছর ধরে চায়ের দোকান করেন। তিন বছর আগে বিদ্যুত পেয়েছেন। আগে রাত আটটার মধ্যে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে যেতেন। এখন রাত ১০-১২ টা পর্যন্ত দোকান চলে। তার দৈনিক কমপক্ষে তিন ঘণ্টা কর্মসময় বেড়েছে। আয় বেড়েছে দৈনিক চার-পাঁচ শ’ টাকা। এভাবে বাজারটির শ’ খানেক দোকানি রাত আটটার মধ্যে বেচাকেনার পাঠ চুকিয়ে চলে যেতেন বাড়িতে। এখন কমপক্ষে রাত ১১টা অবধি বেচা-কেনা করেন। ডিশ এ্যান্টেনার বদৌলতে দেখেন টাটকা খবর। সাবেক মেম্বার জামান হোসেন জানান, এখন খবর দেখি। আর আগে শোনতাম। পাকা রাস্তা। অটো-ভ্যানে চলেন। যেন শহর-গ্রাম এক হয়ে গেছে এসব মানুষের। এমনকি বিদ্যুতের সুবিধায় চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেখানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে এমবিবিএস চিকিৎসক বসেন। সব যেন নাগালের মধ্যে। এখন কষ্ট করে, সময় নষ্ট করে কিংবা টাকা খরচ করে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কলাপাড়া শহরে যেতে হয়না তাদের। বিদ্যুতের এমন সুবিধায় কেউ মুরগির ফার্ম করেছেন। সড়কগুলোতে ইজিবাইকে (ব্যাটারিচালিত অটো) চলাচল করছে। শত শত মানুষ এর মধ্য দিয়ে পেয়েছেন কর্মসংস্থান। আর প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ যানবাহনে সপরিবারে, স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করছেন বাড়িঘরের উঠান পর্যন্ত। রামনাবাদ সংলগ্ন সাগর এলাকায় গড়ে উঠেছে বরফকল পর্যন্ত। মোহনায় ইলিশসহ ধরা অন্যান্য মাছ নিয়ে মহিপুর, আলীপুর কিংবা কলাপাড়ায় ছুটতে হয়না জেলেদের। রাইস ও স-মিল রয়েছে। বহু কৃষক পরিবার বাড়ির জায়গার মধ্যে একটি সেমি পাকা ঘর তুলে ভাড়া দিচ্ছেন এনজিওর কাছে। গৃহবধূ তাছলিমা জানান, তিন বছর ধরে হারিকেনের চিমনি মুছতে হয় না। এর আগেও সোলার প্যানেল ছিল। আর এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত থাকে ঘর। সন্তানদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন কাটছে। লেখাপড়ার পরে টিভি দেখেন। সারাদিনের পরে একটু বিনোদনের জন্য শ্রান্তি নেমে আসে মনেপ্রাণে। এ গৃহবধূর পুরনো হারিকেনটি নেই। জানেন না। বয়োবৃদ্ধ জয়মন বিবি জানালেন, ‘হ্যারা (ছেলে বউ) এ্যাহন প্যাজ (পেঁয়াজ) থেইক্যা শুরু কইর‌্যা কোন কিছুই পাডায় বাডে না। ব্যাবাক কারেন্টের ম্যাশিনে (ব্লান্ডার)।’ এসব দেখার আশা ছিল না এ মানুষটির। তাই দেখছেন। কেরোসিনের গন্ধ যেন ভুলে গেছে এসব অজোপাড়া গাঁয়ের মানুষ। রাত আটটার পরে সাগরপারের এই জনপদে নেমে আসত ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর এখন যেখানেই চোখ যায় রাস্তার দুই দিকে গভীর রাত অবধি বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি। মধ্যরাত পর্যন্ত মানুষের বিচরণ বাড়ি থেকে বাড়ি। হাটবাজার সর্বত্র পদচারণা। যেন এক আলোর বিপ্লব ঘটে গেছে কয়টি বছরে সাগর পারের এই জনপদে। কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুত সমিতির ডিজিএম সুদেব কুমার সরকার জানান, শতকরা ৭০ ভাগ গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ চালু করা হয়েছে। আর আশি ভাগ গ্রামে নতুন লাইন টানার কাজ শেষ হবে জুন মাসের মধ্যে। এ বছরের ডিসেম্বরে অন্তত ২৪৭টি গ্রামের শতভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় চলে আসবে। পল্লী বিদ্যুত সমিতির কলাপাড়া অঞ্চলের পরিচালক প্রভাষক ইউসুফ আলী জানান, ডিসেম্বর নাগাদ সকল মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আসবে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এমপি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় কলাপাড়ায় এবছর ডিসেম্বরের মধ্যে সকল পরিবারকে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা হবে। এমনকি রাঙ্গাবালী উপজেলাকেও বিদ্যুতের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
×