ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেলার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বই পড়া, বিচিত্র অনুভব

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মেলার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বই পড়া, বিচিত্র অনুভব

মোরসালিন মিজান ॥ মেলার শনিবার ছিল ১৭তম দিন। বন্ধের দিনে যথারীতি ভিড় করেছিলেন পাঠক। এদিনও শুরুটা হয় শিশুপ্রহর দিয়ে। বেলা ১১টায় মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয়। এর পর ধীরে ধীরে আসতে থাকেন বড়রা। বিকেলে যথারীতি জমে ওঠে মেলা। এখন বহু নতুন বই দিয়ে সাজানো মেলার স্টল প্যাভিলিয়ন। নানা বিষয়ের ওপর লেখা বই। আগামী প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে বহুকাল পর পাওয়া হলো আলমগীর কবিরকে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা ফিরেছেন নিজের লেখায়। পরিচালনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন সংগঠন ও বেগবান করেছিলেন তিনি। সাংবাদিক ইতিহাসকার ও চিত্রসমালোচক হিসেবেও আলাদা পরিচিতি ছিল। জীবদ্দশায় এসব বিষয়ে লিখেছেন তিনি। ১৯৬০ দশক থেকে শুরু করে ১৯৮৯ সালে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যত লেখা, তার সংকলন ‘চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি।’ রচনা সংগ্রহের প্রথম খ-টি সম্প্রতি মেলায় এসেছে। এতে সংকলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং সাক্ষাতকারসহ মোট ৪৫টি রচনা স্থান পেয়েছে। বইয়ের মূল আলোচনা হয়ে এসেছে পরাধীন দেশের জাতীয় মুক্তি এবং তার সমান্তরালে নিপীড়িত জাতির আত্মপরিচয় তথা সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বপ্ন। আলমগীর কবির একদিকে যেমন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে দেখেছেন, তেমনি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির একাংশের মুক্তিসংগ্রামও প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন। বই পাঠে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা প্রকাশকের। বইয়ের সম্পাদনার কাজ করেছেন আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান ও প্রিয়ম প্রীতিম পাল। সুন্দর একটি ভূমিকা লিখেছেন সলিমুল্লাহ খান। বইটির মূল্য ৯০০ টাকা। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের আরকেটি বই ‘উইলিয়াম কেরী : জীবন ও সাধনা।’ যার নামে নামকরণ তিনি অন্য দেশের নাগরিক ছিলেন বটে। নিজেকে একজন বাঙালী বলেই দাবি করতেন। ভালবেসে বহু বছর এই দেশে ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সংবাদপত্রের পুরোধা পুরুষ। আধুনিক কৃষি উন্নয়নকর্মী। মিশনারি-বৃত্তে অনেকেই তাকে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। বইটিতে ঠিক তা নয়। আরও বিস্তৃতভাবে এসেছেন উইলিয়াম কেরী। লিখেছেন সুশান্ত সরকার। মূল্য ৬০০ টাকা। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল পাবলিকেশন অল্প কিন্তু নির্বাচিত বই প্রকাশ করে আসছে। এখান থেকে এবার বের হয়েছে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘সাত মার্চের বিকেল।’ নামকরা প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই লেখিকার বই পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটি তাঁর নতুন রচনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণটিকে মূল উপজীব্য করেছেন লেখিকা। ইতিহাস নির্ভরতা আছে। আছে সাবলীল উপস্থাপনা। পাঠকের ভাল লাগবে বলেই আশা করা হচ্ছে। কথা প্রকাশের সুন্দর সাজানো প্যাভিলিয়ন। বিকেলে সেখানে গিয়ে অনেকগুলো নতুন বইয়ের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। বিষয়ের দিক থেকে কিছু বইকে আলাদা করা গেল। এই যেমন সালেক খোকনের ‘আদিবাসী বিয়েকথা।’ পাহাড়ী মানুষের উৎসবগুলো এমনিতেই খুব আকর্ষণীয় হয়। আর বিয়ে হলে তো কথাই নেই। বিয়ে ঘিরে নানা লোকাচার, লোকবিশ্বাস, নাচ গান, মিথ ইত্যাদি বিষয় গবেষকের দৃষ্টিতে দেখা ও লেখার চেষ্টা হয়েছে বইটিতে। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে ‘রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা।’ লিখেছেন বেগম আকতার কামাল। বইটিতে রাবীন্দ্রিক ব্রহ্মের স্বরূপ সন্ধানের প্রয়াস। ব্রহ্মভাবনার বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরার চেষ্টা। প্রচলিত রবীন্দ্র চর্চার একটু বাইরে হওয়ায় বইটি ভাললাগতে পারে পাঠকের। সময় প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে রবীন্দ্র নজরুল দুজনকে একমলাটে পাওয়া হলো। বইয়ের শিরোনাম ‘প্রশ্নোত্তরে রবীন্দ্র-নজরুল।’ বইতে বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবিকে নিয়ে নানা প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর। ব্যতিক্রমী বটে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথকে জানা। নজরুল পাঠ। বইটি সম্পাদনা করেছেন সুভাষ সিংহ রায়। পালক পাবলিশার্স থেকে মেলায় এসেছে ‘চেঞ্জিং ল্যান্ডস্কেপ অব ক্রপ সেক্টর ইন বাংলাদেশ।’ বইটি সম্পাদনা করেছেন লেখক সাংবাদিক কাওসার রহমান ও রিয়াজ আহমেদ। উৎস প্রকাশনের স্টলে গিয়ে পাওয়া হলো আইনস্টাইনকে। বইয়ের শিরোনাম ‘আমিই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।’ যতদূর জানা যায়, মহান বিজ্ঞানী নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা মুখ খুলতেন না। জীবদ্দশায় দু’বার তাঁর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন দুই লেখক। সেখানেও যথেচ্ছ কলম চালান তিনি নিজেই। কী ছিল সেই সব কথা, যা তিনি কাউকেই বলতে চাননি? কেন এই আড়াল করা? কী এমন ঘটনা ছিল তাঁর জীবনে? বইয়ে সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা। বিভিন্ন দলিল ঘেঁটে বের করা হয়েছে অজানা এবং অল্পজানা এক অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে। প্রচলিত মিথ বা কিংবদন্তিগুলো একপাশে সরিয়ে ভাল-মন্দ মিলিয়ে যে রক্তমাংসের মানুষ, তাঁকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে বইতে। লিখেছেন অঞ্জন আচার্য। মূল্য ২০০ টাকা। ২২১ নতুন বই ॥ মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ২২১টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ এদিন গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘এ কে এম আহসান ॥ খান শামসুর রহমান ॥ মুজিবুল হক’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনা করেন এম মোকাম্মেল হক, এনামুল হক ও অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরী। নির্ধারিত প্রবন্ধকার মনজুরে মওলা শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচকরা বলেন, এ কে এম আহসান, খান শামসুর রহমান এবং মুজিবুল হক- এঁরা প্রশাসনিক কর্মদক্ষতায় রাষ্ট্রের গণমুখী অভিমুখ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। চিন্তা ও মননে লালিত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের সমাজ ও মানুষের কল্যাণে দায়বদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলার মানুষের সংগ্রামী অভিযাত্রায় নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তাঁরা সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এ কে এম আহসান, খান শামসুর রহমান এবং মুজিবুল হকÑ এঁদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন কিন্তু পা-িত্য, দেশপ্রেম এবং কর্তব্যনিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবাই অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। দেশে ও বিদেশে কর্মসূত্রে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যেমন পালন করেছেন তেমনি দেশের মুক্তি আন্দোলনের নানা পর্বে অবদান রেখেছেন। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভাবনগর ফাউন্ডেশন, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র ও নকশীকাঁথার শিল্পীরা বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিলেন।
×