ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম সারোয়ার

অভিমত ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা কাম্য নয়

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা কাম্য নয়

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এটি এই অর্থে যে, মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলী রয়েছে। মানবীয় গুণাবলীকে এই অর্থে উৎকৃষ্ট বলা যাবে যে, মানুষের মাঝে আছে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা এবং বিবেচনা। আবার আমরা এও জানি সমাজের সব মানুষের ভেতরে এই গুণাবলী সমানভাবে থাকে না। কোন একটি সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মাঝে যদি মনুষ্যত্বের চেয়ে পশুত্বের পরিমাণ বেশি পরিলক্ষিত হয় তবে তাকে আমরা বলি নিকৃষ্ঠ সমাজ। আমাদের রাষ্ট্রের বয়স প্রায় সাড়ে চারযুগ হয়ে গেল। মহাকালের তুলনায় এটি অনেক কম সময়। তবে একটি স্বাধীন জাতির পরিপুষ্টতার জন্য এটি একেবারে অল্প সময় নয়। একটি পরাধীন দেশের সমাজ সর্বোচ্চ পরিশীলতায় বিকশিত হতে পারে না। কারণ তাদের ওপর আইন-কানুন এবং নিষ্ঠুরতা চাপিয়ে দেয়া হয় অন্য সংস্কৃতি থেকে, অন্য জাতি থেকে। এক দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন অন্য দেশের মানুষের ওপর আইনের প্রয়োগ করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা হয় নিষ্ঠুর। কিন্তু কোন স্বাধীন দেশের জনগণের ওপর যদি তাদের নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ঠুরতা চাপিয়ে দেয় তবে বুঝতে হবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো মানবীয় গুণাবলী নিয়ে পূর্ণবিকশিত হয়নি। একটি সমাজে পশুত্বের প্রকাশ নানাভাবে ঘটতে পারে। যে সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পশুত্ব পরিলক্ষিত হয়, সে সমাজের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই মানবিক হতে পারে না। যে সমাজে অসহায় মানুষের নিরাপত্তা নেই, মানুষের মর্যাদা নেই, যে সমাজে ন্যায়বিচার নেই, মিথ্যার ওপরে সত্যের স্থান নেই- সে সমাজ সভ্য সমাজ হয়ে উঠতে পারে না । একটি স্বাধীন দেশে, একটি সভ্য রাষ্ট্রে পুলিশ হবে জনবান্ধব। যে রাষ্ট্রে পুলিশ হয় জনগণের বন্ধু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয় আস্থার প্রতীক, সে রাষ্ট্রে কোন অপরাধীই টিকে থাকতে পারে না। চোর, ডাকাত, খুনী, জঙ্গী কেউই না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারা, রাজনীতিবিদরা কিংবা সরকার যতই বলুক ‘আমাদের পুলিশ জনবান্ধব’-মানুষ তা গ্রহন করবে না। পুলিশ কতটুকু জনবান্ধব হতে পেরেছেন, তা নির্ভর করবে জনগণ পুলিশ সম্পর্কে কী ভাবছে ও তাদের কতটা সহজভাবে গ্রহণ করছে তার উপর। এটি সত্য যে, রাষ্ট্রের অন্যান্য শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ে পুলিশদের কাজের ধরন ভিন্ন এবং তাদের সমস্যাও অনেক। পুলিশকে কাজ করতে হয় সমাজবিরোধী আর অপরাধীদের নিয়ে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা তাদের ঠিক রাখতে হয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু আইন প্রয়োগ করার সময় তাদেরও মনে রাখতে হবে তারাও মানুষ, যে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে মানুষের উপর এবং আইনগুলোও সকল মানুষের জন্য । গত দুই দিন আগে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ঘুরছে। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট্ট মেয়েকে রাস্তায় ফেলে মধ্যযুগীয় কায়দায় তিনজন পুলিশ সদস্য পেটাচ্ছে। শিশু মেয়েটি হয়ত ভুল পথে রাস্তা পার হচ্ছিল। কিন্তু যে রকম নিষ্ঠুরতা নিয়ে ওই তিন পুলিশ সদস্য মেয়েটিকে নির্যাতন করছিল তাতে তাদের আধুনিক বিশ্বের মানুষের কাতারে কোনভাবেই ফেলা যাবে না । গত দুই দিনে রাষ্ট্রে আরও অনেক বড় ঘটনাও ঘটে গেছে। এই দেশের তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিলে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারেও নিয়ে যেতে হয়েছিল পুলিশকে। সেই হিসাবে রাষ্ট্রের এই রকম একটি জটিল সময়ে একটি শিশুকে তিনজন পুলিশ সদস্য নির্মমভাবে পেটাচ্ছে, সেই ঘটনা মানুষের উপর তেমন অভিঘাত ফেলবে না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষেরই এক একটি নিজস্ব জগত আছে। প্রতিটি মানুষ নিয়েই আমাদের সকলের প্রিয় রাষ্ট্র। এক একটি ঘটনা নিয়েই একটি রাষ্ট্রের সার্বিক চিত্র উঠে আসে। ঘটনা হলো, এই বর্বর মধ্যযুগীয় নির্যাতনটি হলো খোদ ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক মানুষের সামনে। ভাবছি ঢাকার রাস্তায় যদি এই রকম একটি ঘটনা ঘটে থাকে, তবে সারাদেশের খবর কতটা ভয়াবহ! বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে নাগরিক মনিটরিংয়ের কোন সম্ভাবনা নেই সেখানকার মানুষেরা কেমন আছেন! বাংলাদেশে সব পুলিশ খারাপ এটি বলার কোন উপায় নেই। বরং স্বীকার করতেই হবে আমাদের পুলিশদের ভেতরে বেশিরভাগই ভাল এবং দক্ষ। বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এ সংখ্যা প্রতি লাখ জনগণের জন্য মাত্র ৩২ জন। ভারতে এ সংখ্যা ১২৯ জন, আর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা ২৩০ জনেরও বেশি। এত কম জনবল নিয়ে স্বল্প সুযোগ-সুবিধার ভেতরে তাদের কাজ করতে হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হয়। আমরা জানি পুলিশের যে কোন নেতিবাচক খবর যেভাবে মিডিয়ায় আসে, পুলিশরা যে পরিমাণে ভাল কাজগুলো করে সেগুলো মিডিয়ায় প্রায় আসেই না। তাই পুলিশদের সম্বদ্ধে আমাদেরও মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তবে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে যে স্বল্পসংখ্যক উদ্ধত আর অপরাধীমনারা আছে তাদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। তারা আইন প্রয়োগের সময় যদি বাড়াবাড়ি করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে মানুষ পুলিশকে আস্থায় নিতে পারবে না। যে বিশালসংখ্যক পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরলস কাজ করছে তাদের ত্যাগও মানুষের কাছে তখন মূল্যায়িত হবে না। প্রাচীনকালে এই যুগের মতো পুলিশ ছিল না। তখন জনগণই সংঘবদ্ধভাবে অপরাধীদের দমন করত। তারপর যখন নগররাষ্ট্র সৃষ্টি হলো তখন নগরের শাসকদের রক্ষার জন্যে সৃষ্টি হলো রক্ষকবাহিনী। ইংরেজী চড়ষরপব শব্দ এসেছে গ্রিক শব্দ চড়ষরং থেকে, যার অর্থ ঈরঃু বা নগর। নগরের শাসকশ্রেণীকে নিরাপত্তা দিতেই পুলিশের সৃষ্টি। উপমহাদেশে পুলিশের প্রবর্তন করেন মোগল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা স¤্রাট বাবর। মুঘল আমলে নগরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তাকে বলা হতো কোতোয়াল। কোতোয়াল একটি হিন্দী শব্দ যার মানে কেল্লারক্ষক। এখনও প্রতিটি নগরের প্রধান থানাকে বলা হয় কোতোয়ালি থানা। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসক ও নতুন জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় পুলিশ বাহিনীকে তখনকার মতো আধুনিক করা হয়। ১৮৩০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে পুলিশের অদক্ষতা ও দুর্নীতি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলা হয়। তারপর ১৮৬১ সালে প্রবর্তিত হয় চড়ষরপব অপঃ. পাকিস্তান আমলের পুলিশরাও ছিলেন সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতার। বাংলাদেশের জন্মের প্রথম লগ্নেই পুলিশ জানান দিয়েছিল তার বাঙালী রক্তের পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে। প্রথম বাঙালীর অস্ত্রের গর্জনও একজন পুলিশের। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদও একজন পুলিশ। প্রথম প্রহরে যখন সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তাও করেনি, বহু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বহু এলিট যখন চিন্তাও করেনি, তখনই সেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকহানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের প্রতিরোধে রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরাই অস্ত্রাগারের ঘণ্টায় হ্যামারের বাড়ি দিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেয়। তারপর ওয়্যারলেসযোগে রাজারবাগ থেকে প্রতিরোধের খবর দেয় দেশের সব পুলিশ ফাঁড়িতে। তারপর প্রায় ১৩ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য পাকিস্তানী কমান্ড থেকে বেরিয়ে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশবাহিনী জানত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু দেশের ইজ্জত রক্ষার জন্য আর মুক্তির জন্য জীবন দেয়া সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারদের ভারি অস্ত্রের গোলায় ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল প্রতিটি পুলিশ ব্যারাক, শহীদ হয়েছিল অনেক পুলিশ সদস্য কিন্তু একজনও মাথা নত করেন নি। তারপর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি সঙ্কটে তথা দেশ মাতৃকাকে রক্ষায় বাংলাদেশের পুলিশ জীবন দিয়ে রাষ্ট্রের মান-সম্মান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে এসেছেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় যখন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে তখনও প্রথম যারা জীবন দেন তাঁরা হলেনÑ দুইজন দেশপ্রেমিক পুলিশ সদস্য। বাংলাদেশের পুলিশ ১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় প্রথম জাতিসংঘের শান্তি মিশনের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তারপর তারা শান্তি রক্ষায় অবদান রাখেন আইভরিকোস্ট, সুদান, দারফুর, লাইবেরিয়া, কসাবো, পূর্ব তিমুর, ডি আর কঙ্গো, এ্যাঙ্গোলা, হাইতিসহ পৃথিবীর সংঘাতময় বহুদেশে। এই রকমের একটি পুলিশ বাহিনীতে যারা থাকবেন তাদের কেউ একটি মামুলি কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি শিশুকে বর্বরভাবে পিটাবে তা কোনভাবেই মানা যায় না। পুলিশ বাহিনীর সম্মান আর মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থেই এদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের কোন বাহিনীই ভুলে যেতে পারে না আমাদের এই দেশটি অনেক রক্তের বিনিময়ে কেনা। বহু বছরের, বহু সাধনার ফলে আর অনেক সংগ্রামের পর আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশটি । আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। তারা তো ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কোন পুলিশ নয়, তারা পাকিস্তানের বর্বর প্রশাসনেরও পুলিশ নয়। তাই এই রকম উদ্ধত আচরণ তাদের সঙ্গে মানায় না। এগুলোর রাশ টেনে ধরুন। এগুলোকে প্রশ্রয় দিলে বিশ্বের মাঝে আমরা আমাদের সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে পারব না। লেখক : ব্যাংকার
×