ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাসরীন মুস্তাফা

আ মরি মায়ের ভাষা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আ মরি মায়ের ভাষা

. ॥ এক ॥ পৃথিবীটা ঘুরছে, এ কথা আমি জানি, তুমি জান, সবাই জানে। কেবল জানে না পৃথিবী নিজে। শামুক ধীরধীর বলল, তুমি ঘুরছ। তোমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাই আমি ধীরে চলি। তাই আমার নাম ধীরধীর। পৃথিবী আদ্যি কাল থেকে যেমন ছিল, তেমনই আছে। মহাকাশে বাস করে। সূর্যের আলো গায়ে মাখে, কখনও এক দিকে, কখনও তার অন্য দিকে। পৃথিবী ভাবত, এমনি এমনি থাকা হয় এভাবে। এর জন্য ঘুরতে হয়, তা ওর জানা ছিল না। ধীরধীর জানাল। পৃথিবী জানতে চায়, ও কীভাবে ঘুরছে। ধীরধীর তখন মুখ চেপে শ্বাস নেয়। তারপর নিজের চারপাশে ডিগবাজি খায়। বলে, তুমি ঠিক এইভাবে ঘুরছ। পৃথিবী যাতে ভাল করে বুঝতে পারে, তাই ধীরধীর বার বার ঘোরে। নানা দিকে ঘোরে। কখনও ঘুরতে গিয়ে কাত হয়ে যায়। কখনও ডিগবাজিতেই আটকে যায় মাথাটা। তখন চাকার মতো ভনভন করে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় বহু দূর। অনেক বার দেখার পর পৃথিবীর মনে হলো, বোঝা গেছে ব্যাপারটা। ও আসলে এইভাবে ঘুরছে...পৃথিবীটা সেইভাবে ধীরধীরের মতো মুখ চেপে শ্বাস নেয়। আর তখন পৃথিবীর গায়ের উপর থাকা কোন এক আগুন পাহাড়ের মুখ ফেটে আগুন বেরিয়ে আসে গলগল করে। আগুনকে ভয় পায় পৃথিবীতে বাস করা সবাই। আগুন পাহাড় ভয় ধরিয়ে দিল পাখিদের, পশুদের, মানুষদের। সবাই পালাতে শুরু করল। চেঁচিয়ে উঠল যার যার মতো। পাখির চেঁচানি পাখি বুঝল। পশুর চেঁচানি পশু বুঝল। মানুষের চেঁচানি বুঝল মানুষ। পৃথিবীর খুব মায়া। সঙ্গে সঙ্গে মেঘদের বলে, বৃষ্টি ঝরাও, বৃষ্টি! শীতল হোক আগুন। বৃষ্টি ঝরল। আগুন নিভে গেল। শান্ত হ’ল পাখিরা। শান্ত হলো পশুরা। শান্ত হলো মানুষরা। সূর্য সবাইকে দেখে রাখে মহাকাশে। পৃথিবী যা করল, তা দেখে ধমক না দিয়ে পারল না। বলল, মতলবটা কী তোমার, বল তো! এমনিতেই আমার আলোর গরমে সবার যা তা অবস্থা। পৃথিবী খুলে বলল সব। সূর্য সব শুনে হা হা করে হাসে। বলে, তুমি যে ঘুরছ, তা টের পেতে চাও? চাই। তাহলে সবুর কর। আসুক ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটা। কেন কেন? কী হবে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে? ওই দিন তুমি বুঝবে, সত্যিই ঘুরছ। আচ্ছা! . ॥ দুই ॥ ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটা এলো বটে। পৃথিবী চমকে ওঠে সুর শুনে। খুব খুব খুব দূরে, খুব খুব দূরে, খুব দূরে, দূরে, কাছে, একদম কাছে, কাছে, দূরে, খুব দূরে, খুব খুব দূরে, খুব খুব খুব দূরে বাজছে সুর। না না, একটা সুর নয়। অনেক অনেক সুর। সব মিলিয়ে যেন একটাই সুর। সেই এক সুর পৃথিবীকে ঘিরে যেন গোল হয়ে ঘুরছে। নাকি ঘুরছে পৃথিবীটাই? কী সেই সুর? মানুষের সুর। এক সুর, তবে একদম আলাদা আলাদা কেন? একদম কাছে বাজছে সুর, সঙ্গে কথা এ রকম- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? পৃথিবী শুনছে একদম কাছে বাজতে থাকা সুর। একটু পর কাছের সুর বাজে একদম কাছে। কাছে বাজে সুরের কথা এই রকম- বিসাউম পাহিলু ফেরি মেরো ভাইকো... দূরে বাজে সুর এই কথা নিয়ে- কেইপ আস গালিউ পামিস্ত্রি দভিদেসইম্ত পিরমাজি... খুব দূরের সুর আর তার কথা এ রকম-ফিবরাইর সুয়ারাত ফি দামী আখইয়া কাইফ ইমকিন আন উনছা ফি... খুব খুব দূরে বাজছে যে সুর, তাতে কথা আছে- এল টুয়েন্টি ফার্স্ট দে ফেবরেরো ফিলমাদো এন লা সাংগ্রে... পৃথিবী খুব খুব খুব দূরের সুরটা শুনতে চায়। খুব খুব খুব দূরের সেই সুরের ভেতর কথা আছে এ রকম-টুয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারি ফিল্মড ইন মাই ব্রাদারস ব্লাড, হাউ ক্যান আই ফরগেট? সত্যি সত্যিই দূরের সুর বাজে একদম কাছে। তারও পরে আগে যা ছিল খুব দূরের সুর, তা হয়ে গেল একদম কাছের সুর। এভাবে খুব খুব খুব দূরের সুরও একদম কাছের সুর হয়ে বাজে না মেলা কথা নিয়ে। পৃথিবী বুঝতে পারে, ও ঘুরছে বলেই খুব খুব দূরের সুরও একদম ওর বুকের কাছে বাজতে পেরেছে। তাই ও শুনতে পেয়েছে একদম কাছে আসা নানা ভাষার কথা একই সুরে। সুরটার শুরু ছিল একদম কাছে- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? পৃথিবীর বুকের গভীরে কে যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে, কেউ কি ভুলতে পারবে সেই কথা? ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল মানুষ, যাদের নাম ছিল রফিক, শফিক, বরকত! কোন্ সে ভাষা? মায়ের ভাষা। সেই সাহসী ছেলেদের মায়ের ভাষা ছিল বাংলা। তাই ওরা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। আজ পৃথিবীর সব জায়গায় আর সব মানুষ সেই কথা মনে করে সুর তুলছে নিজের ভাষায়, মাতৃভাষায়। কথা কিন্তু একটাই। নিজের ভাষায় সবাই বলছে, মায়ের ভাষা হলো নিজের ভাষা। তাকে ভালবাসতে হয়। সবাই নিজের ভাষায় একই সুরে গাইছে, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? কেউ ভুলবে না। পৃথিবী যেমন ভুলতে পারছে না, ও ঘুরছে। ঘুরছে বলেই গানের সুর দূর থেকে চলে আসছে একদম কাছে। আসলে পৃথিবীই ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছে সুরের একদম কাছে। খুঁজে ফিরছে সবার মায়ের ভাষা। আ মরি মায়ের ভাষা! অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×