ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বই বিক্রি হয়, হয় না দুটোই সত্য!

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বই বিক্রি হয়, হয় না দুটোই সত্য!

গ্রন্থমেলা এখন পরিণত। এই অর্থে যে, অর্ধেকের বেশি সময় ইতোমধ্যে পার হয়েছে। বইও এসেছে অজ। গত ১৬দিনে ২ হাজার ৩৫০টি নতুন বই আসার খবর জানিয়েছে বাংলা একাডেমি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের যেসব বই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে সেগুলোর অধিকাংশই চলে এসেছে। মেলায় যাব, বন্ধের দিন না হলে কী করে যাই? এমন দুশ্চিন্তা যাদের, তারাও কয়েকটি শুক্র ও শনিবার পেয়েছেন। বসন্তের প্রথম দিন, ভালবাসার বিশেষ দিবসে ঘুরে বেড়ানো হয়েছে বেশ। কিন্তু বই কেনা হলো কি? এ কাজে কতটা মনোযোগী পাঠক? এমন প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে দেদার বিক্রি। আবার কখনও সন্দেহ সংশয়। বই হাতে বাড়ি ফিরছেন ক’জন? তাহলে কি ঘুরে বেড়ানোই শেষ কথা? না, প্রশ্নগুলোর চটজলদি উত্তর হয় না। এর পরও ১৬তম দিনে উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, বই বিক্রি হচ্ছে এবং হচ্ছে নাÑ দুটোই সত্য! শুক্রবার ছিল পূর্বঘোষিত শিশুপ্রহর। এ উপলক্ষে সকালেই খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের হাত ধরে মেলায় আসতে থাকে। আর বিকেল হতেই ঢল নামে সব বয়সী মানুষের। দেখতে দেখতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল খোলা চত্বর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। কিছু স্টলের সামনে সবসময়ের মতোই ছিল উপচেপড়া ভিড়। উদাহরণ হতে পারে অন্যপ্রকাশ। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বড় প্যাভিলিয়ন। চারপাশ দিয়ে বই বিক্রির ব্যবস্থা। এর পরও পাঠক বই দেখার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। দূর থেকে নাম বলে বই সংগ্রহ করতে হচ্ছিল। হ্যাঁ, এখান থেকে মূলত বিক্রি হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের বই। প্রয়াত লেখকের বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে দিতে বিক্রয়কর্মীরা গলদঘর্ম হচ্ছিলেন। কিন্তু পাঠক ছিলেন অক্লান্ত। তার মানে, বই বিক্রি হচ্ছে? এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম কিছুটা হাসলেন। বললেন, কেন বিক্রি হবে না? প্রতিবারের মতো এবারও ভাল বিক্রি হচ্ছে। আমাদের প্যাভিলিয়নে প্রায় অর্ধশত বিক্রয়কর্মী কাজ করেন। সবাই ব্যস্ত। অনেক বই আনতে আনতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। পাঠক চাইছেন। আমরা দিতে পারছি না। প্রায় অভিন্ন দৃশ্য দেখা গেল তা¤্রলিপির সামনে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা। প্রতিষ্ঠানটি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইয়ের জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি। এখান থেকে জনপ্রিয় লেখকের অনেক বই বের হয়েছে। এসেছে নতুন বইও। সংগ্রহের জন্য কিশোর কিশোরীদের সে কী ছোটাছুটি! বাবা-মায়ের সহায়তা নিয়ে তবেই প্যাভিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিল তারা। বই হাতে পাওয়ার পর যে খুশি, সেটিও দেখার মতো। প্রতিদিনই এখানে ভিড় লেগে থাকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বই বিক্রি হয়। প্যাভিলিয়নের সামনেই ছিলেন প্রকাশক তরিকুল ইসলাম রনি। বললেন, আমাদের পাঠক আছে। বই দিতে পারলে পাঠক পাওয়া যায়। অনেকে অভিযোগ করেন, আজকের প্রজন্ম বই পড়ে না। কেনে না। আমার এখান থেকে তো কিনছে। সেবা, অনন্যা, সময়, কাকলী, পাঞ্জেরী, অনুপম, ইত্যাদি, ঐতিহ্যসহ নামকরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিও সহজে চোখে পড়ে। অনেকে বলতে পারেন, সিরিয়াস বই সৃজনশীল বই তো বিক্রি হয় না। আসলেই কি? এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমি হতে পারে ভাল উদাহরণ। একাডেমি সুনির্বাচিত বইয়ের বিপুল সংগ্রহ। গবেষণামূলক মননশীল বই প্রকাশ করে থাকে। এবং মেলার সবকটি স্টল থেকেই বই বিক্রি হচ্ছে। একাডেমির দেয়া তথ্য মতে, গত ১৬ দিনে মেলায় বিক্রি হয়েছে মোট ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বই। গত বছর একই সময়ে বিক্রি হয় ৬৭ লাখ টাকার বই। তার মানে এ বছর বিক্রি আরও বেড়েছে। ইউপিএল, মাওলা ব্রাদার্স, প্রথমা, দিব্য, পাঠক সমাবেশ, এ্যাডর্নের মতো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করা হয়। পাঠকও বই কিনতে ভিড় করেন প্যাভিলিয়নগুলোর সামনে। শুক্রবারও ভিড় লেগে ছিল। মাওলা ব্রাদার্সে গিয়ে দেখা যায়, রাজনীতি দর্শন ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয় ধারার বইগুলোর চেয়ে বিক্রি মোটেও কম নয়। বরং বেশি। মেলা ঘুরে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হকের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের বহু বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান। আমরা ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। খুব নির্বাচিত বই প্রকাশ করি। এর পরও বিক্রি ভাল। আমাদের প্রকাশিত সব ধরনের বই-ই ভাল বিক্রি হয়। মানসম্পন্ন সৃজনশীল বই প্রকাশ করা গেলে ক্রেতার অভাব হয় না বলেই মনে করেন তিনি। তবে প্রকাশকরা বই বিক্রির কোন তথ্য দিতে রাজি না হওয়ায় সঠিক করে বলা যায় না, কার কেমন বিক্রি। তবে বই বিক্রি না হওয়ার আক্ষেপও অনেকেই করেন। কোন কোন প্রকাশক খুবই হতাশ। তারা বলছেন, পাঠক কম। বই কেনে না। ঘুরে বেড়াতে আসেন। অভিযোগের কিছু সতত্যাও আছে বৈকি। মেলা থেকে বের হওয়ার পথে এক ঘণ্টার মতো সময় দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, বহু মানুষ দল বেঁধে বের হয়ে আসছেন। সেই তুলনায় বই হাতে আছে এমন মানুষের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। তার মানে, মেলায় আসা মানুষের সংখ্যার অনুপাতে বই বিক্রি কম হয়। অনুপাতের যে পার্থক্য সেটির সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালও। শুক্রবার মেলায় এসেছিলেন তিনি। ভক্তদের অটোগ্রাফ দেয়ার এক ফাঁকে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমার তো মনে হয় বই বিক্রি কমছে। এই যে এত এত ছেলে মেয়ে আমাকে ঘিরে ধরে আছে, তারা বই কিনছে। অটোগ্রাফ নিচ্ছে বটে। তারও বেশি তুলছে ছবি। পাঠক বাড়ছে না বলেই মনে হয় আমার। এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলা মেলার সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলার আলাদা আবেগ। বই বিক্রি বড় কথা নয়। এর পরও সবচেয়ে বেশি বই এই মেলায় বিক্রি হয়। পাঠক প্রচুর বই কেনেন। এবারও কিনছেন। বাংলা একাডেমির সিরিয়াস বই পাঠক নিজ উদ্যোগে খুঁজে নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বই যেহেতু এত বিক্রি হচ্ছে, অন্যদেরও বই বিক্রি হচ্ছে। তবে মেলায় যত মানুষ আসেন সবাই বই কিনবেন, এটা আশা করা যায় না। তবে এভাবেই তো শুরুটা হয়। শুরুটা হচ্ছে। বইয়ের বিক্রি বাড়াতে হলে এর মান বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ২৭৩ নতুন বই মেলায় এদিন নতুন বই এসেছে ২৭৩টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাইফুদ্দীন চৌধুরী, হাশেম সুফী এবং সুনীলকান্তি দে। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×