ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুখরোচক হলেও জেনে শুনে বিষ খাচ্ছে মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 মুখরোচক হলেও জেনে শুনে বিষ খাচ্ছে মানুষ

ওয়াজেদ হীরা ॥ কর্মব্যস্ত রাজধানীর ব্যস্ততম মোড় শাহবাগ। সেখানে দেখা গেল স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত খুদে শিক্ষার্থী যার নাম আদেল। তার হাতে এক ধরনের রঙিন জুস তুলে দিলেন মা হাসনাত বেগম। নিজের সন্তানকে কেন রাস্তার ময়লাযুক্ত এই বিষাক্ত খাবার খাওয়াচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে স্কুল শেষে ছেলে কিছু খাওয়ার বায়না রোজই ধরে। একেক দিন একেকটা খায়। দেখে শুনেই খাওয়াই। এই জুসে বিশেষ কেমিক্যাল মেশানো হয়েছে বিক্রেতার এমন স্বীকারোক্তিতে হাসনাত বেগম বলেন, আগে এসব নিয়ে ভাবি নাই। এখন থেকে চেষ্টা করব খোলা খাবার যতো কম খাওয়ানো যায়। আদেলের মতো রাজধানীর বুকে হাজারো শিশুর বায়না রাখতে হয় হাজারো মায়ের। তবে কোন কোন মায়ের সচেতনতা আর তীক্ষè দৃষ্টির অনেক শিশুই খোলা খাবার খেতে পারে না। তবে সেই সৌভাগ্যবানদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সকাল থেকে দুপুর কিংবা রাত। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কিংবা আশপাশে খোলা জায়গায় বিক্রি হচ্ছে হরেক লোভনীয় ও মজাদার খাবার। খোলা জায়গায় বিক্রি হলেও খাবার দেখেই জিভে পানি এসে যায়। ছোট্ট শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক সবাই খাচ্ছে এই খাবার। আর বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, এসব দেখতে খাবার হলেও আসলে মানুষ খাচ্ছে বিষ। যার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের শরীরে নানা ধরনের ভয়ঙ্কর অসুখ বাসা বাঁধছে। আর ক্রমেই মৃত্যুপথে এগিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো তৈরির প্রক্রিয়া আর পরিবেশন স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ভোক্তারা। ব্যবসায়ীরা লাভের আশায় বিক্রি করছেন আর ভোক্তারা জেনে বা না জেনেই খাচ্ছেন। কোটি মানুষের পদচারণা রাজধানীর বুকে। গাবতলী থেকে সায়েদাবাদ কিংবা মতিঝিল থেকে উত্তরা। খোলা খাবার বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই। অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত গুলশান বনানীতেও রাস্তায় খাবার বিক্রি বেশ জমজমাট। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে এই বেচাকেনা। যদিও মধ্যরাতে ঢাকার কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া ফুটপাথে বেচাকেনা থাকেনা বললেই চলে। এই খাবারের তালিকায় প্রায় সবই যেমন পাওয়া যাচ্ছে রাস্তায় তেমনি মিলছে সস্তায়ও। শুধু সস্তার কারণেই নয় মুখরোচক হওয়ার কারণে সচেতন শিক্ষিত ব্যক্তিরাও জেনেশুনেই দেদারছে গিলছেন এই খাবারগুলো। রাস্তায় পাওয়া খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ঝালমুড়ি, ফুচকা, চটপটি, পেয়ারা, আমড়া, বিভিন্ন আচার, তেলে ভাজা বিভিন্ন খাবারের মধ্যে বেগুনি, পেঁয়াজো, ছোলা, বিভিন্ন ফলের জুস, বিভিন্ন ধরনের সরবত, বিভিন্ন পিঠা ইত্যাদি হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও সকাল দুপুর বা রাতের খাবারের জন্য রুটি কিংবা ভাত সঙ্গে বাহারি আইটেম রান্না করে বিক্রি হচ্ছে খোলামেলা। অনেক খাবার বিশেষ করে খোসাযুক্ত ফল ধুয়ে খাওয়া গেলেও অন্যান্য খাবারে প্রতিনিয়ত রাস্তার ধুলো ময়লা পড়তে থাকে। এমনকি দুর্গন্ধযুক্ত বিভিন্ন এলাকায়ও এসব বিক্রি করলে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। বিশেষ করে রাজধানীর জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান এলাকায় এক দিকে যেমন লোকজন দাঁড়িয়ে মূত্র ত্যাগ করছেন আবার পাশেই আয়েশ করে খাবার খাচ্ছেন। গুলিস্তানের মতো অনেক জায়গায় খাবার বিক্রিতেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখা গেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টার বা টার্মিনাল এলাকায়। খাদ্য উপাদানের চেয়ে যেখানে ক্ষতিকর জীবাণুর পরিমাণই বেশি। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালের সামনেও খোলা খাবার বিক্রির হিড়িক দেখা গেছে। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে কথা হয় ক্রেতা ইব্রাহিম হোসেনের সঙ্গে। রাস্তায় বিক্রি করা জুস খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জন্যও কিছু খোলা খাবার কিনলেন। এই খাবার কতোটা স্বাস্থ্যসম্মত তার জবাবে তিনি বলেন, এতোসব মেনে তো খাবার খাওয়া যায় না। ক্ষুধা লাগে, ভাল লাগে তাই খাই। আর যেহেতু খাবারের ওপর থেকে ময়লা দেখা যায় না তাই জীবাণু নিয়ে কোন সমস্যা মনে করি না। অন্যতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। যেখানে দেশের মেধাবীরা লেখাপড়া করছেন অথচ তারাও ঝুঁকেছেন এই খোলা খাবারে। কখনও দল বেঁধে খাচ্ছেন এই খাবারগুলো। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঝালমুড়ি খেতে খেতে শিক্ষার্থী তানিয়া বলেন, আসলে এই সব খাবারতো আর সব সময় খাই না এই ঝালমুড়ি, ফুচকা একটু খাই। সঙ্গে থাকা বান্ধবী মিথিলা বলেন, আসলে আমাদের বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় যারা বিক্রি করেন তারা বেশ পরিচ্ছন্ন। তবে না খাওয়াই উত্তম সে কথাও বলেন তিনি। বিশ^বিদ্যালয়ের গ-ি পেরিয়ে অন্যান্য জায়গা ঘুরে একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষতিকর হলেও এসব খাবারের প্রতি তাদের বেশ আকর্ষণ। যে কারণে খাওয়ার সময় তারা মনে করেন না এসব ক্ষতিকর। ঢাকা মেডিক্যালের অন্তত ছয়জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। যারা সবাই এ ধরনের খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে যেহেতু মুখরোচক খাবার একেবারে না খেয়ে থাকা যায় না। তাই যতোটা কম খাওয়া যায় সে কথাও বলেছেন কেউ কেউ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মোঃ জালাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক জায়গায় স্ট্রিট ফুড বিক্রি হচ্ছে। কোন খাবারই ক্ষতিকর নয় যতক্ষণ ক্ষতিকর কিছু না মেশানো হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তৈরির প্রক্রিয়া হয়তো ভাল নয়। এছাড়াও এসব খাবার সতর্ক হয়েই খাওয়া উচিত। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ আসিফুর ইকবাল জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষের হৃদরোগ এসব বাইরের খাবার থেকে হলেও মানুষকে বারবার বলা সত্ত্বেও খেয়ে যায়। অসুখ বাসা বাঁধলে হাসপাতালে দৌড়ায়। অথচ আগে থেকে সচেতন থাকলে অনেক রোগ থেকে এমনিই ভাল থাকা যায় বলেও মনে করেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, আমরাই এসব খাবার খেতে নিরুৎসাহিত করি। তবুও সবাই খায়। একই তেল বারবার ব্যবহার হচ্ছে মানুষ খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে। নানা রোগ সৃষ্টি হচ্ছে মানবদেহে। ফার্মগেটে ফুচকা বিক্রেতা ফরহাদ বলেন, ক্ষতিকর কিনা জানি না। চেষ্টা করি পরিষ্কারভাবে বিক্রি করার। আর ক্ষতিকর হলে এতো মানুষ কেন খায় উল্টো সেই প্রশ্নও করেন বিক্রেতা। এসব ফুচকা, চটপটি বা ঝালমুড়ির মত মুখরোচক খাবার তৈরির পেছনের গল্পটা আরও ভয়াবহ। রাজধানীর কয়েকটি ফুচকা তৈরির কারখানায় ঘুরে দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব তৈরি হচ্ছে। যেখানে শ্রমিকদের ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানও নেই। কখনও দুই তিনদিনের বাসি খাবারও চলে যায় রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে। নোংরা পরিবেশে হাত পা দিয়ে মাড়িয়ে তৈরি করা এসব খাবারই আবার পরিবেশন হচ্ছে খোলা জায়গায়। ফুচকা তৈরির কারিগর জলিল বলেন, আমরা এসব তৈরিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পরিচ্ছন্নতার আবার কি আছে। আমাদের হাত পা ধোয়াই থাকে সবসময়। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারেই ই-কোলাই, সালমোনেলা ও ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। এদিকে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা এক সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গবেষণা করেছিলাম। আমাদের দেশে একটা টার্গেট গ্রুপকে কেন্দ্র করে এই খাবার বিক্রি হয়। বিশেষ করে দুপুরের খাবার রাতের খাবার খায় নি¤œ আয়ের মানুষ বিভিন্ন শ্রমিক বা রিক্সাচালক। আর কিছু খাবার যেমন ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি এ ধরনের খাবার খায় অধিকাংশ মানুষ। যেখানে শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিরাও আছেন। দেশের এই খাবারের মান এবং তৈরির প্রক্রিয়া ভালো নয় তাই নানা সমস্যা সৃষ্টি হয় বলেও জানান তিনি। খাদ্যের মান ঠিক রাখতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হওয়াসহ নিজেকেও একটু বেশি সচেতন থাকার পরামর্শ দেন ড. নাজমা শাহীন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মেসী অনুষদের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তার খাবার তৈরি হয় মূলত আটা, ময়দা, বেসন, মাছ, মাংস, ডিম, শাকসবজি ও তেল দিয়ে। দিনের পর দিন একই তেল ব্যবহার করা হয় বলে তা পুড়ে যায় এবং এই তেল হৃদরোগ সৃষ্টি করে। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরে ময়লা ও জীবাণুযুক্ত হাতে রাস্তার খাবার তৈরি করা হয় বলে এসব খাবার খাওয়া ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় জেনেছি এসব রাস্তার খাবার খেয়ে ৯৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন অসুখে ভুগছে। এর মধ্যে ভয়ঙ্কর রোগও আছে। এসব খোলা খাবারে এমনসব জীবাণু আছে যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সেই সঙ্গে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, ক্যান্সারসহ এমন রোগ নাই যা তৈরি হয় না। তবুও মানুষ খাচ্ছে। মানুষের সচেতনতাও এসব খাবার থেকে ফেরাতে পারছে না মত এই অধ্যাপকের। তিনি বলেন, দেশে আইন আছে, মাঝে মধ্যে প্রয়োগও হচ্ছে এবং মানুষ খাচ্ছে রোগে আক্রান্তও হচ্ছে। পরিকল্পিত না হওয়ায় এসব হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এখনো সময় আছে পরিকল্পনামাফিক এসব খাবার তৈরি নজরদারি বা বিক্রি করার বিষয় দেখভালের। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকারী বেসরকারীভাবে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছি। বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে উল্লেখ করে বলেন, আমাদের ১৮টি মন্ত্রণালয় এবং ৪৮৬ স্থানীয় সরকারের সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে অনেক কাজের সুফলও পেতে সময় লাগবে বলে জানান তিনি। চ্যালেঞ্জ থাকলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে আরও জোরালো কাজ করা হবে বলেও জানান তিনি।
×