(গতকালের পর)
দোষারোপের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই দেশে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে পরীক্ষা চলাকালীন আমলারা বললেন, এগুলো নির্বাচনী বছরে সরকারকে বিপাকে ফেলতে সরকার বিরোধীদের চক্রান্ত। আমলারা যখন ব্যথর্তা ঢাকতে রাজনৈতিক কার্ড খেলতে শুরু করেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে। এও সত্যি তাদের নিয়ন্ত্রনে আপনার দুর্বলতা স্পষ্ট হয়। যারা এ ধরনের কথা বলছেন তাদের বলুন এই চক্রান্তে জড়িতদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে। সেটাই তো তাদের কাজ। ঘুষ-দুর্নীতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি বাস্তবতা। তাই মনে হয় সহনীয় মাত্রায় ঘুষ গ্রহণে আপনার দেয়া পরামর্শ হয়তো সেবা প্রার্থীদের কষ্ট কিঞ্চিত লাঘবে একটি মরিয়া চেষ্টা! তার পরও এটি প্রত্যাশিত নয়। শিক্ষা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় কথাগুলো উল্লেখ করা। প্রশ্ন ফাঁস রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে আপনাকে। আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলা বন্ধ করুন। শেষ বিচারে কোন আমলা নয়, ইতিহাস আপনাকেই দায়ী করবে। কাজেই সামান্য সৎ পরামর্শ দেয়ার যোগ্যতা যারা রাখে না, তাদের আপনি রাখবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।
এবার আসি প্রশ্ন ফাঁস রোধের বিষয়ে। একটি কথা খুব পরিষ্কারভাবে বলাছি, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে যারা চায়ের কাপে ঝড় তোলেন, যেসব প-িত অধ্যাপক ডক্টরেট সাহেবরা বাক্য বানে মস্ত্রীকে ধোলাই করেন পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে তাদের কোন স্বচ্ছ ধারণা নেই যে আমি নিজেও সে দলে। তবে এ কথা বলার সময় এসেছে জনাব নাহিদের বা তার বদলে অন্য কারও পক্ষে এককভাবে প্রশ্ন ফাঁস রোধ সম্ভব নয়। এ জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ। গতানুগতিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কোন সমাধান দেবে না। বরং এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে অভিজ্ঞদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। হতে পারেন তারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে বিতরণের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। আবার রথী-মহারথী আমলাদের ভয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা চাকরিরত নিম্নপদস্থ কর্মচারী। মন্ত্রী মহোদয় নিশ্চয়ই জানেন, বহু ডিগ্রীধারী ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রির মতের মূল্য অনেক সময় বেশি হয়ে দাঁড়ায়। এখনও আমাদের এমন কিছু শিক্ষক আছেন, যাদের সততা কিংবদন্তিতুল্য, তাদের ডাকুন, কথা শুনুন। পেশাগত কারণেই গত কিছুদিন আমরা নতুন প্রজন্মের এমন কিছু তরুণের সংস্পর্শে এসেছি যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং প্রশ্ন ফাঁস রোধে তাদের মডেল প্রস্তাবনাও উপস্থাপন করছেন। এটি তারা করছেন নিখাদ দেশপ্রেম থেকে। তাদের কথা শোনা যেতেই পারে। বহু দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ আছেন যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেন তাদের কথাও শুনুন। সমালোচনার মুখে শিক্ষমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বলে সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি। খেলার মাঝপথে পদত্যাগ কোন ভাল ক্যাপ্টেনের কাজ নয়, কাম্যও নয়। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলে কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন তা জানতে চেয়েছেন। আপনি বলেছেন বিটিআরসির সহযোগিতার অভাবের কথা। যেখানে আমরা সবাই জানি প্রশ্ন ফাঁস ও ছড়িয়ে পড়ার প্রধান মাধ্যম আজ ইন্টারনেট, সেখানে আপনার কাজ ছিল বিটিআরসির সহযোগিতা নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে কী উদ্যোগ নিয়েছেন জানতে পারি? তাদের কয়েকটি চিঠি দিয়ে এমন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমাধানের জন্য বড় আমলার দরকার নেই। কেন একটি আলাদা সেল করা যায় না, যা সত্যি কার্যকর? মন্ত্রণালয়ের বা বিটিআরসির কর্মকর্তারা যদি দায়ীদের চিহ্নিত করতে না পারেন, তো তরুণ প্রযুক্তিবিদদের ডাকুন। বিষয়টি অনেকটা হ্যাকিং প্রতিরোধে হ্যাকার নিয়োগের মতো। এ যুগে ইন্টারনেট কিছু চালাচালি করে লুকিয়ে থাকা কতটা সম্ভব? আরেকটি বিষয়ও বলেছেন, প্রশাসনের কাম্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না। প্রশাসনের কারা তা স্পষ্ট করে বলুন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মুখ বন্ধ রেখে তো লাভ নেই।
সম্প্রতি একটি জরিপে উঠে এসেছে প্রশ্ন ফাঁস রোধে এ বিষয়ের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া হোক। বার বার ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে সে চেষ্টাতে দোষের কিছু নেই। সেনাবাহিনী জাতির প্রয়োজনে আগেও এগিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীর ইন্টারনেট দক্ষতা, প্রযুক্তি সুবিধা অনেক এগিয়ে, প্রশাসনিক কাঠামো অনেক সংহত, প্রয়োজনে তাদের পরামর্শ নিন। পরীক্ষার্থীদের আধ ঘণ্টা আগে হলে প্রবেশ একটি ভাল উদ্যোগ। তার পরও দেখছি হলে প্রবেশের ১৫-২০ মি. পূর্বে প্রশ্ন আসছে ইন্টারনেটে। এক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র খোলার দায়িত্বরত ব্যক্তিদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তাক করাই যায়। এটি প্রতিরোধে শিক্ষমন্ত্রী কি নতুন প্রজন্মের ওপর আস্থা রাখতে পারেন? নিয়ম করুন সিলগালা করা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট প্রতিটি কেন্দ্রে উপস্থিত ৫ জন পরীক্ষার্থীর উপস্থিতিতে ৯-৩০ মিনিটে খুলতে হবে এবং সরকার নির্ধারিত ফর্মে তাদের নাম, রোল লিখে স্বাক্ষর নিতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষায় নতুন করে ৫ জন এ কাজে অংশ নেবে। এতে করে তাদের দায়িত্ববোধও গড়ে উঠবে। যাদের জন্য পরীক্ষা তাদের কথা শুনুন। ওরাই ভাল জানে ইন্টারনেটে কোথায় প্রশ্ন পাওয়া যায়। সে জন্য বিটিআরসি লাগে না। আর এই তরুণেরা এখনও অতটা পচে যায়নি। সমস্যা হচ্ছে, প্রশ্ন পেয়ে তারা বিষয়টি জানাবে কোথায়? জানালেও ব্যবস্থার নিশ্চয়তা কী? হয়রানির আশঙ্কা তো আছেই। পরীক্ষার্থীদের সাহায্য চান, ওরাই পথ দেখাবে। প্রতিটি জেলায় প্রশ্নপত্রের প্রতিটি প্রশ্নের শেষে জেলাভিত্তিক আলাদা চিহ্ন যোগ করুন, যাতে নেটে ফাঁস হলেও জেলাটি বোঝা যায়। এতে তদন্তের পরিধি কমে আসবে। জানি, সমাধানের এহেন পদ্ধতি শুনে অনেকেই তেড়ে উঠবেন, আইন দেখাবেন। শিক্ষমন্ত্রী তাদের প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাটি মনে করিয়ে দিন: দেশ ও দশের স্বার্থে প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করব। আর আমলারা যদি তাদের দোহাই অব্যাহত রাখেন, তাদের কেবল এটুকু বলার আছে ‘মশাই, পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে! কাজেই চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?’ বিষয়টি যখন জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকেছে, তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই এবং একজন শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগও কোন সমাধান নয়। বিনয়ের সঙ্গে বলি, সমস্যা সমাধানে যাত্রা শুরুর প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে সমস্যা স্বীকার করে নেয়া। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছেÑ এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী উচ্চারিত দুটি শব্দ ডেসপারেট ও এগ্রেসিভকে ভিত্তি করে আমরা শুরুটা করতে পারি, যে শুরুটা হবে সমন্বিত প্রচেষ্টায়। শিক্ষামন্ত্রী প্রথম যে কাজটি করতে পারেন সেটি হলো, এই সমন্বিত প্রচেষ্টার ক্ষেত্র প্রস্তুতে উদ্যোগ নেয়া। আসুন, সবাই মিলে ঘুরে দাঁড়াই। জাতির স্বার্থে এর বিকল্প নেই। (সমাপ্ত)
লেখক : সাংবাদিক