ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব শর্মা

বইমেলা মাঠে, নেটে

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বইমেলা মাঠে, নেটে

বইমেলা মাঠে, নেটে- কথাটা শুনে চমকে উঠলেন? চমকানোর কিছু নেই। নেট সংস্কৃতির এই যুগে ঠিক যতটা আমরা চোখ রাখছি মেলার মাঠে কিংবা স্টলে তার চেয়ে অনেক বেশি তাকাচ্ছি নেটে। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকসহ অনলাইন গণমাধ্যমগুলো স্থাপন করে দিচ্ছে পছন্দসই বইকেনার যোগসূত্র! প্রিয় লেখকের কি কি বই এলো মেলায় তা সার্চ দিয়ে বা লেখকের ফেসবুক থেকে জানা যাচ্ছে সহজেই। আর ছবিসংস্কৃতি তাতে যুক্ত করছে ভিন্নমাত্রা। এ কথা হলফ করেই বলতে পারি, ফেসবুক আসার আগে বাঙালী একক কোন ব্যক্তি এত ছবি উঠেছে এমন নজির বোধ হয় নেই দেশে! এতে করে পরিপাটি থাকার মাত্রাটাও বৃদ্ধি পেয়েছে। একেকটি মোবাইল ফোন ক্যামেরা হয়ে উঠায় সহজ হয়েছে ক্লিকবাজি! যা বইমেলার প্রচারের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। তবে অনেকেরই এ নিয়ে অভিযোগ আছে, তাদের বক্তব্য- লাইক কমেন্টের চক্করের প্রতি ঠিক যতটা মনোযোগী মেলায় আগতরা ততটা আগ্রহী নন, বই কেনার প্রতি! ফ্যাশনের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্যাশন। সত্যিই কি তাই! অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যার মোদ্দাকথা, যে রাধে, সে চুলও বাঁধে! . বাড়ছে ভিড়, বাড়ছে বিক্রি! মূলত বইমেলা জমে উঠে ১৫ তারিখের পর থেকে। আর সেটা পূর্ণতা পায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে। মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় মূল কেনা-বেচা। প্রতিবারের মতো এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। পাঠকদের উপস্থিতিতে যেমন মেলা কানায় কানায় পূর্ণ ঠিক তেমনই বিক্রিও হচ্ছে ভালো। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের অন্যতম স্বত্বাধিকারী জহিরুল আবেদিন জুয়েল জানালেন, পহেলা ফাল্গুন থেকে পুরোপুরি জমে উঠেছে বইমেলা। ইত্যাদি থেকে এবার হাসান আজিজুল হক এবং সেলিনা হোসেন রচনাবলী ১ ও ২ প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে পাঠকরাও বেশ আগ্রহী। সবমিলিয়ে প্রত্যাশা পূরণের পথেই অগ্রসর হচ্ছে এবারের বইমেলা। কথাসাহিত্যিক ফারজানা মিতু জানালেন, অধিকাংশ দিনই তিনি মেলায় উপস্থিত থাকেন। এবারও আছেন প্রথম দিন থেকেই। মাঝে দুুদিন ভিড় কম থাকলেও শঙ্কা কেটে যাওয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বইমেলার প্রাঙ্গণ। ক্রেতাদের উপস্থিতি বাড়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে বিক্রি। এবার মেলায় তার চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। . বইমেলায় প্রথম বই বইমেলায় প্রথম বই প্রকাশের আনন্দই আলাদা। জীবনের প্রথম বই তাও আবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হওয়া, লেখকমাত্রেই এ নিয়ে থাকে বাড়তি উত্তেজনা। নিজ সন্তান ভূমিষ্ঠের আগে মা ঠিক যেভাবে আনন্দে উদ্বেলিত থাকেন একজন লেখকও প্রথম বই হাতে পাওয়ার স্বপ্নে থাকেন বিভোর। এবারের বইমেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক লেখকের নতুন বই বের হচ্ছে। ইতোমধ্যে বের হয়েছে ৩০ জনের বই। এই তালিকায় যেমন নবীন লেখক আছেন তেমনই আছেন দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন লেখকও। তাদেরই একজন আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ইব্রাহীম চৌধুরী। তিন দশক ধরে লেখালেখি এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও লেখা মলাটবন্ধি করা হয়নি কখনো। বইমেলায় এবার তার প্রথম বই বের হতে চলেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে আলাদা কোনও অনুভূতি নেই। নির্বিকতা ধারণ করে কাজ করি। আমি সৌভাগ্যবানদের একজন। সব সময় পাঠকপ্রিয়, সেরা সার্কুলেশনের পত্রিকায় কাজ করেছি। একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে, যা দেখেছিÑ তা প্রকাশ করেছি। বইয়ের মাধ্যমে আমার বক্তব্য খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। অনেক বেশি পাঠকের টার্গেট করে আমাদের সংবাদ লিখতে হয়। সে কারণেই বই প্রকাশ নিয়ে ভাবার সময়ই পাইনি কখনো। তো বই প্রকাশের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। এ গুরুত্বকে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না, মনে করলাম। দিনের বেশিরভাগ সময়ই আগে আগে কলম থাকত, এখন কী বোর্ড থাকে। দ্রুত ঘটনা, অনুঘটনা বলে যাওয়ার কাজ করতে করতে একটি অভ্যাস জন্ম নিয়েছে। কোন কিছু নিয়ে বিস্তারিত লেখার অবকাশ আর হয় না। এ কাজ করা দরকার। প্রথম বইটি একটি পান্থ কথনের সংকলন। যারা চেনা জানা, তাদের ভালো লাগবে। না লাগলেও ক্ষতি নেই। অন্বয় প্রকাশনী থেকে ‘স্মৃতিতে ও সংবাদে’ বইটি দু’একদিনের মধ্যে মেলায় আসবে। তিনি জানান, কোন পরিকল্পনা ছিল না। একজন প্রকাশক, সম্পাদকের একান্ত চাপে পড়েই বই প্রকাশ করা। সত্যিকথা বলতে কি, প্রকাশের কাজ তো বেশ ঝামেলার! বিয়ের সময় আমার এক স্বজন বলেছিলেন, অনুষ্ঠান নিয়ে চুপ থাকাই ভালো। বেশি লোক জানালে সামাল দেয়া যাবে না? বই প্রকাশ নিয়েও একই পরামর্শ পেয়েছি! প্রথম প্রকাশিত বই নিয়ে লেখক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান বেশ উচ্ছ্বসিত। তিনি জানান, লেখালেখির সবুজ ভুবনে পাঁচবছর ধরে বসবাস করলেও এ বছরই প্রথমবারের মতো আমার বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথম বই! ভাবতেই এক অদ্ভুত শিহরণ আমাকে জেঁকে ধরে। খ--খ- মুহূর্তগুলো, চিন্তা, অনুভব ও বিশ্লেষণগুলো বইয়ের ক্যানভাসে ফ্রেমবন্দী হচ্ছেÑ ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগে। লেখালেখির হাতেখড়ি ‘কবিতা’র মাধ্যমে হলেও কিছুদিন পর থেকেই গল্প লেখা শুরু করেছিলাম। কবিতা ও গল্প দুটিই সমানতালে লিখেছি, এখনও লিখছি। ক’বছর আগে হঠাৎ উপলব্ধি করি, কবিতা-গল্পে ভাব ও বিষয়কে সূক্ষ্ম ও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় ছিল, যেসব বিষয়ে আমি বিস্তারিত বলতে চাইতাম, জানাতে চাইতাম ভালো ও মন্দ লাগার অনুভূতি, অভিমতগুলো। সেই অভিমত, অনুভব, বিশ্লেষণগুলোর যথাযথ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলাম। ‘সাহিত্যের অনুষঙ্গ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’-এর রচনাগুলো এই অভিযাত্রার নির্বাচিত ফসল। এ পা-ুলিপিটি ‘দেশজ পা-ুলিপি প্রতিযোগিতা’য় নির্বাচিত ও পুরস্কৃত হয়েছেÑ এটাও আমার প্রথমগ্রন্থের জন্যে কম প্রাপ্তি নয়। বই প্রকাশের পর সেটি আর লেখকের থাকে না। সাহিত্যের অনুষঙ্গ ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থটি এখন পাঠকের হয়ে গেলো। যদি গ্রন্থটি পাঠকের কাছে ভাল লাগেÑ সেটিই আমার জন্যে হবে পরম মহার্ঘ। . প্রচারণায় এগিয়ে নারীরা বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে পুরুষ লেখকদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে রয়েছেন নারী লেখকরা। আর প্রচারণার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন ফেসবুককে। ক্যাপশনসহ সাবলীলভাবে বইয়ের কাভার ফেবুতে আপ করে সহজেই দৃষ্টি কারছেন তারা। প্রবাসী লেখিকা জেসমিন চৌধুরী তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, ‘সাতজন নারী, সাতটি বই-কলাম, গল্প, উপন্যাস। পনেরোশ’ টাকার মতো খরচ হবে সবগুলো বই কিনতে। বইগুলো কিনুন, পড়ুন, সমালোচনা দিন, লেখকদেরকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করুন। যদিও বলা হয় ‘ডোন্ট জাজ আ বুক বাই দ্য কাভার’ তবুও আশা করি বইগুলোর নাম এবং প্রচ্ছদ আপনাদেরকে টানবে। পুশ সেল নিপাত যাক, পুল সেল শুরু হোক।’ নান্দনিক কথার সঙ্গে প্রচ্ছদ সংযুক্ত করে একের পর এক ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন সব বয়সের লেখিকারা। যার ফলে অনুসারীদের পক্ষে তাদের প্রিয় লেখকের বই কেনা সহজ হচ্ছে। এক্ষেত্রে কবি মনিকা আহমেদের ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা যেতে পারে- ‘সেই কোন শরৎ রাতে প্রথম কবিতা লেখা! তারপর কেটে গেছে বহুকাল। একটু একটু করে ভরে গেছে কত মাছরাঙা বসন্তবলার খেরো খাতা। বর্ষা রাতে নাকে শুধু লেবু ফুলের ঘ্রাণ এসে ঝপঝপ। তীব্র সে ঘ্রাণে ঘুমুতে না পারা অসহ্য যন্ত্রণায় কবিতায় ডুবেছি। কত নৌকো ছেড়ে গেছে ঘাট থেকে অজানা জল পথে, হিসেব রাখিনি। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ভিজেছি মৌন রাত্রিদিন। পাখিডাকা ভোরে মেতেছি হলুদ পাতার পরে রোদের ছায়ায় লুকোচুরি খেলায়। আমার সবুজ রঙা সংসার সাজাতে সাজাতে কত প্রজাপতি উড়ে গেছে...রাত জাগা তারারা বলেছে, ঘুমোও, ঘুমোও.. আমি চোখের পাতাকে শাসন করেছি- রাত জেগে লিখেছি অন্তহীন রাত্রির রূপ-ধূসর রং দিয়ে এঁকেছি তামারোদ আর জলজ শব্দে ভেঙেছি আমার চেতনার দৃপ্ত বালুচরিমেঘ; বড় নীরবে লিখে গেছি আমার মননের, আমার স্বপ্নের, কুহক সময়ের কাব্য। তবু কিছুই লিখিনি মনে হয় এতকাল- কবিতার বই কেন নেই আমার! বন্ধুদের প্রশ্নে বুক বিদ্ধ করে; বছর বছর বইমেলা আসে যায়... সেই প্রবল চাওয়া থেকেই বুকের গুপ্তধন খুলে দেয়া- আজ সকালের উড়াল বাতাসে খুলে গেল- জানালায় বুনোমেঘ’ জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে এমন কথামালা তার প্রিয়জনদের যে আকৃষ্ট করেছে কমেন্ট দেখেই তা উপলব্ধি করা যায় অনায়াসে। নারী লেখকদের প্রচারণা প্রসঙ্গে কবি সিক্তা কাজলের ভাষ্য, সময় পাল্টেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। ফেসবুক যেহেতু বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তাই প্রচারণার ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটিকেই বেছে নিচ্ছেন লেখিকারা। যার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে বই নিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ছে না। . কবির নতুন উপন্যাস আর জে রাজহংসী মূলত কবি হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠলেও মারুফ রায়হান উপন্যাসও লিখে থাকেন। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আর জে রাজহংসী’। এটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.। উপন্যাসটির কাহিনী সংক্ষেপ হলোÑ লায়লা শর্মিন রেডিও সুর অবসরের আর জে, মানে রেডিও জকি। সেখানে নাম রাজহংসী। তার শো ‘ফিউচার ফিউশন’ তরুণদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। কাজটি উপভোগ করে সে। এ তার এক ধরনের নেশা, সৃষ্টিশীল কাজ। নিজেকে মেলে ধরা, অন্যের ভাবনাকে গ্রহণ, সামনে এসে পড়া কোন সমস্যাকে দশদিক থেকে পর্যবেক্ষণ করে একটা সমাধানে আসার চেষ্টাÑ সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশা। কিন্তু এই আনন্দের কাজ করতে গিয়ে যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনার মধ্যেও যে পড়তে হয়! ইস্কান্দার মির্জা সর্বনাশা ফাঁদ পাতে। রাজহংসী নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হলেও সে-রাতে রেইন ট্রি-তে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলÑ এমন একটা অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ে। রেডিও থেকে তার কাজটা চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতেই অল্পবয়সী মেয়েরা ভেঙে পড়ে, অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু রাজহংসী গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বঞ্চিত লাঞ্ছিত নিপীড়িত লাখো নারীর লড়াইয়ের সঙ্গে নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলে। তার পাশে পায় সাবেক বস, সৎ বাবা এবং বন্ধুকে; আর হ্যাঁ, সর্বংসহা মা ও মাতৃসমা এক স্বাধীন নারীও তার নতুন মিশনে বড় ভূমিকা নেয়। রাজহংসী বুঝতে পারে, ভালোবাসার শক্তি অনেক। যে ভালোবাসে, সে ভালোবাসা পায়ও। ভালোবাসা সীমাবদ্ধ নয়। তার সম্ভাবনা অসীম। আকাশছোঁয়া তার সাধ। সাধ্যও কম নয়। ভালো কিছুর জন্যে ভালোবাসা এক অনিঃশেষ শক্তি হয়ে উঠতে পারে। সুন্দরতম শক্তি। উল্লেখ্য, গত বছর জনকণ্ঠের ঈদসংখ্যায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থবদ্ধ হওয়ার আগে লেখক এটি পরিমার্জনা করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন। উৎসর্গপত্রে লেখা হয়েছেÑ ‘সেই মানবিক মানবীদের, রাজহংসীর মতো যারা মুক্ত স্বপ্নময়ী, আর ডানার শুশ্রুষায় রাখেন বিপন্ন বঞ্চিতাদের’। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। মূল্য ২২৫ টাকা।
×