ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সবুজ মেহেদির রঙিন গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সবুজ মেহেদির রঙিন গল্প

শিশির শরতের হোক আর শীতেরই হোক সে তর্কে বহুদূর। শিশিরকে যতই টানাটানি করা হোক না কেন, শিশির আসলে কাকে ভালবাসে? সম্ভবত দূর্বাকে, দূর্বা মানে দূর্বাঘাস, দেখতে সবুজ চির যৌবনের প্রতীক। শিশিরকে সবুজ দূর্বার ডগায় যতটা প্রাণোচ্ছল দেখায় অন্য কোথাও ততটা নয়। ক্ষীণকায় দূর্বার শীর্ষে শিশির নীরবে ভালবাসা ছড়ায় হিম হিম আবহে। দূর্বা আরও শীতল হয় সতেজ হয়, হয় আরও শ্যামল। এমনি দূর্বাঘাসের মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ কুচক্রী মানুষের মতো বাঁকা, যেন সোজা তার স্বভাবে নেই। পথ কী শুধুই পথ নাকি জীবনের আধ্যাত্মবাদ, একেঁবেঁকে অন্ধকারের গন্তব্যে। কিংবা একলা চলো। এমন এক বাঁকা পথ বেয়ে হেঁটে যায় আলেফ স্কুলের দিকে। আলেফ দরিদ্র কৃষক হারেছ আলির ছেলে। হারেছ আলি সন্তান জন্ম নেয়ার পরে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে কোরান-হাদিসের একটা নাম দিতে বলে। ইমাম সাহেব আলেফ নাম দিলে সে খুশি হয়। হারেছ আলির মনে পড়ে, এ নাম তো কোরানের সুরায় আছে। কী সুন্দর! পবিত্র কোরানের নাম। হারেছ আলি বেহেশতি একট সুখ অনুভব করে। তাকে কে বা কারা বুঝিয়েছে ছেলেকে স্কুলে পড়াও। ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি করবে, তোমার সংসারের অভাব দূর হবে। আলেফ স্কুলে যায় ক্লাস ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে এবার নাইনে পড়ে সে। আলেফ স্কুলে যায়, বাঁকা পথ দিয়ে। পথের দু’পাশে সবুজ দূর্বায় শিশিরগুলো সোনালি রোদে হেসে ওঠে। আলেফ পা ঘাসে বুলিয়ে দেয়, পা ভিজে যায়, হিম হিম স্পর্শে তার শরীর নেচে ওঠে, মুখে হাসি ফোটে, সে হাসিও শিশিরের মতোই। আলেফ একা স্কুলে যায় না- যায় আরও অনেকেই- লাবু, সাজু, গফুর আরও কেউ কেউ। স্কুলে যায় মোল্লা বাড়ির দুধের মতো সাদা মেয়ে আয়েশা। আলেফ আয়েশাকে দেখে এত সাদা কেন মনে মনে ভাবে। মোল্লা বাড়ি ইট দিয়ে তৈরি সাদা রং করা, নাকি সাদা বাড়িতে থাকলে এমন হয়। আলেফের ইচ্ছা হয় সাদা বাড়িতে থাকতে। আলেফ তাকায়-মুখের দিকে নয়, পায়ের দিকে, আয়েশার পায়ে স্যান্ডেল। স্যান্ডেলের মধ্যে একমুঠে আলো, একমুঠো মুগ্ধতা, একমুঠো মুগ্ধতা আলেফের মনে কীভাবে যেন প্রবেশ করে। মন থেকে শরীরে। আলেফ আবার দেখে পায়ের দিকে আয়েশার। এটা কী পা? নাকি অন্য কিছু? পথ হেসে ওঠে, দূর্বাঘাসও হেসে ওঠে, আলেফের মনও হেসে ওঠে কিন্তু মুখ নয়। সে যে মোল্লাবাড়ির মেয়ে। হাসলে সর্বনাশ। ও বাড়িতে তার বাবা কাজ করে। আলেফ দেখে আয়েশার পা- দেখতে দেখতে স্কুলে যায়। স্কুলে পড়ালেখা হয়। স্কুল ছুটি হয়- আলেফ বাড়ি আসে পা দেখতে দেখতে। সবুজ ঘাস, স্যান্ডেল, সাদা পা-স্বপ্নেও দেখে সে- ঘুমের ঘোরে। দিন-মাস চলে যায় ঘাসে আর শিশির পড়ে না। ঘাসগুলো একটু শুকিয়ে যায়। কিন্তু আয়েশার পা শুকোয় না। তেমনি করে হাঁটে সবুজ দূর্বায় পা ফেলে। হাসি ছড়ায়, মুগ্ধতা ছড়ায়, বর্ষা আসে এবার-ঘাসগুলো বড় বেয়ারা হয়ে ওঠে। দূর্বা ঘাসের ডাটা মাথা উঁচু করতে চায়- মনে হয় সবুজের ডানা নিয়ে উড়ে যাবে। আয়েশা স্কুলে যায় বাড়ন্ত দূর্বা ঘাসের ডগায় পা রাখে। পা থেকে দ্যুতি ঝরে, দূর্বাঘাস যেন বুক মেলে দেয় দেবীর পায়ের তলায়। আলেফ দেখে মুগ্ধ হয়, শিহরিত হয়। আবার শীত আসে, শিশিরে দূর্বাঘাস পরি¯œাত হয়। আয়েশা আরও হাসি ছড়ায়। স্যান্ডেল-পা, কী খুশি ছড়ায় সবুজ ঘাসে, ঘাস থেকে আলেফের মনে শরীরে। বার্ষিক পরীক্ষা আসে। আলেফ পরীক্ষা দিতে যায়, আয়েশা যায় আলো ছড়াতে ছড়াতে। এ আলো নেভে না, শেষ হয় না। এ আলো অফুরান। আলো দেখতে দেখতে আলিফ ভাল পরীক্ষা দেয়। ফলাফল হয়। আলেফ প্রথম হয়। আয়েশা প্রথম হতে পারে না। আলেফের মনে এবার খুশি ছড়ায় না, মুগ্ধতা ছড়ায় না। আয়েশা প্রথম হতে পারেনি, সে প্রথম হয়েছে, আয়েশা কী কষ্ট পাচ্ছে? আয়েশা হাসছে-কষ্ট পাচ্ছে না। আলেফ তাকায় আয়েশার দিকে। আয়েশা আরও বেশি করে হাসে। আলেফ হাসতে পারে না। থমকে যায়। আয়েশা কেন হাসে, সেকি প্রথম হতে চায় না? বাড়ি ফেরার পথে আলেফ মাথা নিচু করে আয়েশার পা দেখতে চায়। স্কুলে তার সাথে দু-একটা কথা হয়। আঁকাবাঁকা পথে কখনও কথা হয় না তাদের। সহপাঠী আরও আছে তারা কথা বলে প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে। আজ কথা হয় তাদের পথের মধ্যেই। আয়েশা বলে, তুমি প্রথম হয়েছ আমি খুশি হয়েছি। আলেফ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে, আয়েশা হাসে কিন্তু হাসি আলো ছড়ায় না আলেফ কী দেখছে বুঝতে পারে না। নাকি বেশি আলো ছড়াচ্ছে, আলেফ এত আলো সহ্য করতে পারছে না। আয়েশা হাসতেই থাকে, আবার বলে তুমি কীভাবে পড়ো? আলেফের চোখে এবার আলো আসে, সে বলে বুঝে বুঝে পড়ি, আর কিছু বলতে পারে না। তার মাথা ঝিম ঝিম করে। জিহ্বা ভারি হয়ে যায়। কী যেন বলতে চায় কিন্তু শব্দ ধরা দেয় না। আলেফ আসহায় তাকিয়ে থাকে। পরীক্ষায় রচনা কমন না হলেও দিব্যি সে লিখে দেয় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, কত ভাষা কত কথা, উপমা-উদ্ধৃতি। কিন্তু এখন আলেফ কিছ্ইু বলতে পারে না। হঠাৎ বাড়ি পৌঁছে যায়। পথ এতা তাড়াতাড়ি শেষ হলো কীভাবে? আলেফ বুঝতে পারে না। বাড়ি এসে সবকিছু তার কাছে অন্য রকম মনে হয়। পরদিন অলেফ স্কুলের পথে হাঁটে। আজ আয়েশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। আলেফ এগিয়ে যায়। আয়েশা পাকা আতাফল বাড়িয়ে দেয় আলেফের দিকে। আলেফ তাকিয়ে থাকে। আয়েশা আতাফল নিতে বলে। আলেফ কখন যেন নিয়ে নেয়। আয়েশা খেতে বলে আলেফ কখন যেন খেয়ে ফেলে। আয়েশা জানতে চায় কেমন লেগেছে? আলেফ বুঝতে পারে না কেমন লেগেছে, কথা বলে না। আয়েশা বিরক্ত হয়ে বলে তুমি ফার্স্ট হও কীভাবে? তোমার তো মাথায় কিছু নেই। স্কুলে পৌঁছে যায়, পথ তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় নাকি স্কুল এগিয়ে আসে বোঝা যায় না। এভাবে দিন যায়। স্কুলের বাঁকা পথে তাদের কথা হয় সরল ভাষায়। বাঁকা পথে সরল ভাষা, কী অদ্ভুত! একদিন আয়েশা পান পাতায় মোড়ানো কী একটা আলেফের হাতে দেয়। আলেফ বলে, কী? মেহেদিবাটা তোমার জন্য! আলেফ বলে ছেলেরা কী মেহেদি ব্যবহার করে? আয়েশা জোর করে। নিজের হাত দেখায়। আলেফ তাকায়, চোখের ঝলক লাগে, হাত না মেহেদি কোনটা সুন্দর? কোনটা উজ্জ্বল? সমাধান খুঁজে পায় না সে। গাণিতিক অনেক সমাধানই তার জানা কিন্তু মেহেদি আর হাতের সমাধান বুঝতে পারে না সে। আয়েশা হাসে। আলেফ খুশি হয়। যতœ করে রাখে মেহেদিবাটা। স্কুল আজ অনেক লম্বা সময় হয়। ছুটি যেন হতেই চায় না। আলেফ কখন বাড়ি যাবে, কখন সে মেহেদি বাটা হাতে মাখবে। প্রতিদিন স্কুল চারটায় ছুটিহয়। আজ চারটা কয়টায় বাজবে কে জানে। চারটা আজ অনেক পিছিয়ে গেছে। অনেক পর ঠিক চারটায় স্কুল ছুটি হয়। আলেফ বাড়ি আসে। কিন্তু সবার সামনে এ মেহেদি মাখা যাবে না। আলেফ অপেক্ষা করে সন্ধ্যা-রাতের জন্য, কিন্তু সন্ধ্যা যেন আজ দেরিতে হয়। আজ সব কিছুই দেরিতে- আলেফ বুঝতে পারে না কেন এমন হচ্ছে। রাতে সবাই ঘুমালে আলেফ মেহেদি বাটা বের করে। শুকিয়ে গেছে। পানি মিশিয়ে নরম করে। হাতের নখে মাখে মেহেদি। যতœ করে মাখে। এ মেহেদি মেহেদির মতো নয়। আয়েশার মতো। আয়েশা-মেহেদি-আলেফ। আর ভাবতে পারে না ঘুমিয়ে যায়। দিন যায়, মাস যায় আয়েশা আরও আলো ছড়ায়। আলেফ আরও পড়তে থাকে। বোর্ড পরীক্ষ সামনে এসে যায়। টেস্ট পরীক্ষায় আলেফ প্রথম হয়। আয়েশা হতে পারে না। আয়েশা হাসে, আলেফ চুপ করে থাকে। এবার আলেফ বলে আয়েশাকে, তুমি ফার্স্ট হলে ভাল হতো। আয়েশা বলে; ভাল হতো না। আলেফ বলে; হতো। আয়েশা বলে; না, হতো না। ঝগড়া হয় আয়েশা কথা বলে না। আলেফ দঃখ পায়। আলেফ দুঃখ পায় আয়েশা বুঝতে পেরে সুখ পায়। ভাবে আমার জন্য কেউ দুঃখ পায়, আমার কতো সুখ। বোর্ড পরীক্ষার সময় সমাগত হয়। সবাই গ্রামের মসজিদে মিলাদ দেয়, পাড়ায় ঘুরে মুরব্বিদের দোয়া নেয়, পরীক্ষায় আর দুদিন। সবাই স্কুলে যায় প্রবেশপত্র আনতে। আলেফ যায়, আয়েশা যায়। সবাই প্রবেশপত্র পায় আলেফ পায় না। প্রধান শিক্ষকসহ সবারই কষ্ট হয়। কেরানিকে গালমন্দ করে কিন্তু আলেফের প্রবেশপত্র পাওয়া যায় না। ছাত্ররা সবাই দুঃখ পায়। আয়েশার চোখে জল আসে। আলেফ তাকিয়ে থাকে জলঝরা আয়েশার চোখের দিকে। জল নয় যেন সুখ ঝরে যাচ্ছে। কেরানিকে বোর্ডে পাঠানো হয়। সবাই অপেক্ষা করে। আলেফ বই খুলে দেখতে পায়Ñ সবুজ দূর্বা-স্যান্ডেল-মুগ্ধতা-আতাফল-মেহেদি, কান্না ইত্যাদি। আয়েশা বই খুলে দেখে স্কুল ফলাফল হেড স্যারের ঘোষণা, ফার্স্ট ইত্যাদি। পরীক্ষার দিন আসে, কেরানি আসে। আলেফ স্কুলে যায় কিন্তু প্রবেশপত্র আসে না। আলেফ ফিরে আসে দূর্বা ঘাসের ওপর হেঁটে হেঁটে। পা-স্যান্ডেল দেখতে পায় না। গ্রামময় হয় শোক। সবাই বলে আহা! আয়েশা পরীক্ষা দিতে যায় বাবার সঙ্গে। হাতে প্রবেশপত্র। পরীক্ষায় বসে যায় আয়েশা, শিক্ষক খাতা দেন প্রশ্ন দেন। আয়েশা প্রশ্ন দেখতে পায় না। দেখতে পায় বাঁকা পথ, আলেফ, স্কুল, হেডমাস্টার, ফার্স্ট ইত্যাদি। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অসুস্থ আয়েশাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষার হলে সে যাবে না আর। কেন যাবে? খবর শুনে আলেফ দেখতে যায় আয়েশাকে। এই প্রথম এ বাড়ির অন্দর মহলে প্রবেশ। অসুস্থ আয়েশা শুয়ে আছে। আলেফ পাশে দাঁড়ায়। আয়েশার মা আদর করে বসতে বলে। আলেফ চেয়ারে বসে। তাকিয়ে থাকে আয়েশার চোখে। আয়েশা তাকিয়ে থাকে আলেফের চোখে। আলেফ আর কিছু দেখতে পারে না, বুঝতে পারে। কখন যেন হঠাৎ বুঝতে পারে। বুঝতে পেরেই দেখে আলেফের হাতের মধ্যে আয়েশার হাত। কীভাবে এলো আলেফ ভাবে। তাকিয়ে দেখে সে হাতে মেহেদির আলপনা।
×