ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

অল্প বয়সের গৃহিণী ও মায়ের মানসিক সুরক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অল্প বয়সের গৃহিণী ও মায়ের মানসিক সুরক্ষা

বাংলাদেশ উন্নয়নের বিকাশমান ধারায় ক্রমাগত সামনের দিকে চললেও অর্ধাংশ নারীরা আজও হরেক রকম সমস্যার আবর্তে সময় অতিবাহিত করছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের জীবনকে নিরাপদ কিংবা শঙ্কাহীন করতে হিমশিম খায়। সার্বিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো যে কোন দেশের যথার্থ নিয়ন্ত্রক। আর অর্থনীতি সেখানে মূল এবং গভীরতম স্থানে। সুতরাং আর্থিক নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা মানুষের জীবনযাত্রাকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় আবার এর বৈপরীত্য ও দৈনন্দিন কর্ম প্রবাহকে সঙ্কটের আবর্তে ফেলে দেয়। যা শুধু পুরো দেশেরই নয় সংসার এবং পরিবারকেও এক বিপন্ন অবস্থার মুখোমুখি করে। পশ্চাদপদ রক্ষণশীল সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে নারীরা পড়ে সব থেকে বেশি বিপাকে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতা দিয়ে আধুনিক যথার্থ মানুষ হওয়া একেবারে চ্যালেঞ্জের মতো। এখানে মূল নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে মানসিক চৈতন্যের বিকাশ। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন বস্তুগত সংস্কৃতি (প্রযুক্তি) ও অবস্তুগত সংস্কৃতি (মনমানসিকতা) সমান তালে চলতে পারে না বলে আধুনিক সমাজের সংজ্ঞা দেয়াও কঠিন হয়ে যায়। অর্থবিত্ত কিংবা বিলাসবহুল জীবন সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সঙ্গে যদি মনোজগতের আধুনিকতা সম্পৃক্ত হতে ব্যর্থ হয়। অর্থাৎ প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে পরিহার করে সময়ের দাবি মেটানোর মতো নতুন জাগরণ যদি মনোলোককে স্পর্শ করতে না পারে। আগেই উল্লেখ করেছি সমস্যা সঙ্কট সব দায়ই পোহাতে হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশ নারীকে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বিত্ত-নির্বিত্তের ফারাকও এক্ষেত্রে অনেক জোরালো। পরিবার থেকেই একটি মেয়ে বৈষম্যের শিকার হয়ে নিজেকে গড়ে তোলে। এখানে ভাইবোনের তারতম্যও চোখে পড়ার মতো। আধুনিক মা-বাবারা অবশ্য এখন অনেক বেশি সচেতনই শুধু নন ছেলেমেয়েদের সমতার ভিত্তিতে বড় করার সিদ্ধান্তেও প্রত্যয়ী। তবে এই সংখ্যা পুরো জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক কম। কিন্তু ভুক্তভোগীরা নিজেরা সচেতন না হলে পর্বত প্রমাণ সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়া আসলে সহজ হবে না। পরিবার থেকে একটি মেয়েকে সুশিক্ষিত করার দায় শুধু বাবা-মায়ের নয় বালিকাটি নিজেও। তাকেই প্রথম বুঝতে হবে দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা পাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ সামনে খোলা নেই। শুধু শিক্ষায়ই নয় পেশাতেও স্বাবলম্বী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। যাতে যে কোন দুঃসহ বিপর্যয় সামলানোর মতো বৈষয়িক এবং মানসিক দুটো ক্ষমতায় তার আয়ত্তের মধ্যে থাকে। এর অন্যথা জীবনকে হরেক রকম বিপর্যয়ের আবর্তে ফেলতে সময় নেবে না। কিন্তু স্বাভাবিক জীবন প্রণালীর ব্যত্যয় হরহামেশাই অনেকের প্রত্যাশাকে ধুলায় লুটিয়ে দেয়। সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পুরুষেরা নিজে কর্মক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন বড় ধরনের সিদ্ধান্তে আসতে চায় না। পরিবার থেকেও সেটাকে মেনে নেয়া হয় না। এটাই স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম থাকাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। এ ধরনের নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেতনা যতদিন মেয়েদের মধ্যে গ্রথিত না হবে ততদিন তারা কোনভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। এমনও দেখা যায় একজন মেধাবী মেয়ে সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী জীবনের মাঝপথে ‘বিয়ে’ নামক একটি নতুন অধ্যায়ে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। এই অবস্থা যদি কোন পুরুষের হতো সে কিন্তু উপস্থিত পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে শিক্ষা জীবন শেষ তো করতই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা থেকেও বিরত থাকত না। এই শক্ত মনোবল মেয়েদের হওয়াও জরুরী। সদ্য বিবাহিত মেয়েটি সাংসারিক হতে গিয়ে সাবেক ছাত্রীতে রূপ নিল। পরবর্তীতে হরেক রকম টানাপোড়নে কোনমতে স্নাতক পর্বটি শেষ করল। তারপর? পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে যে পরিমাণ সুযোগ এবং দৃঢ় মানসিকতা আবশ্যক তার ছিটেফোঁটাও তার নাগালের বাইরে থাকল। ইতোমধ্যে সে আরও একটি আকাক্সিক্ষত জীবনের ছোঁয়া পেল। মাতৃত্বের মহিমায় নিজেকে পূর্ণ করার তাগিদে সমস্ত প্রাপ্তির আনন্দে বিভোর হলো। মাতৃত্ব যে কোন মেয়ের চিরায়ত বাসনা। তবে তা তড়িঘড়ির ব্যাপার নয়। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে নিজেকে সবদিক থেকে যোগ্য করে তোলাটা বাঞ্ছনীয়। এভাবে জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো যখন পার হয়ে যায় ধীরে ধীরে মা হওয়ার প্রত্যাশিত গৌরবও তাকে আর সুস্থির থাকতে দেয় না। সমবয়সী এবং অতি পরিচিত স্বজনরা যখন নিজেদের গড়ে তোলার সাধনায় নিমগ্ন তখন তাকেও পেয়ে বসে অনেক কিছু হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণা। আর এসবের সুযোগ নিতে থাকে চারপাশে ঘিরে থাকা অবিবেচক কাছের মানুষ। অবসাদ, ক্লান্তি আর বিষণœতায় জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয়। মানসিক বৈকল্য এনে দেয় শারীরিক দুর্বলতা। তবে কি এভাবেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় পার হতে দেয়া যাবে? এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় আদৌ আছে? সঙ্কট যখন সর্বগ্রাসী হয় সেখান থেকে উত্তরণের পথও খুঁজে নেয়া খুব কঠিন নয়। যে সাধের সংসারের জন্য একদিন সবকিছু বিসর্জন দেয়া এমনকি নিজেকেও। সেই পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তায় আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় বের করতে হবে। সহজ এবং স্বাভাবিক সমাধান যা কিছু ঘটে গেছে জীবনে সবটাই স্থির চিত্তে গ্রহণ করা। যেখানে আসলে কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু যদি নতুন করে কিছু তৈরি করতে হয় তাহলেও সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিঃসঙ্কোচে, নির্বিঘেœ কোন সম্মানজনক পেশায় নিজেকে জড়াতে হবে। সেটা ক্ষুদে উদ্যোক্তা হিসেবেও শুরু করা যেতে পারে। অল্পবিস্তর পুঁজি খাটিয়ে যে কোন ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যবসায়িক আঙিনায় বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা এখন উল্লেখ করার মতো সদ্য সমাপ্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় গিয়ে কয়েক নারী ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় তারা শুধু বিয়ে নয় এক সন্তানের জননী হওয়ার পর নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ধরে নিজেদের তৈরি করা কয়েক নারী উদ্যোক্তা এখন সফল এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। যারা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাদের ব্যবসা শুরু করলেও এখন তা ৫০ লাখ, ৫ লাখ, ২৫ লাখ এবং ১০ লাখ টাকার পুঁজিতে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হতাশ কিংবা দিশেহারা হওয়ার মতো কিছুই এখনও হয়নি। নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়ানোর দৃঢ়শক্তি আর মনোবল ফিরে পেতেই হবে। সংসার, সন্তান থেকে শুরু করে এমনকি স্বামীর জন্যও নতুনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, পারিবারিক জীবন সুস্থির এবং নিরাপদ হবে সর্বোপরি শারীরিক এবং মানসিক অবসাদ আর ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আত্মশক্তিতে স্থির লক্ষ্যে শুধুই সামনের দিকে তাকানো। অন্যায় আবদার, আলোচনা কিংবা সমালোচনাকে তোয়াক্কা করা যাবে না। তবে গঠনমূলক পরামর্শ অবশ্যই আমলে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে একা মানুষ বাঁচতে পারে না। চলতে পারে না। পারিপার্শ্বিক সাহায্য সহযোগিতা পেতে গেলে নিজেকেও অনেক উদার ও সহনশীল করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাঁচার উপায় একেবারে নিজের হাতের মুঠোয়। সুযোগ এবং সময়ের সদ্ব্যবহার এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরী। রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলা যায়Ñ বিপদে মোরে রক্ষা করো এই নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্ছনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
×