ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে বছরে ১৩ হাজার শিশু আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দেশে বছরে ১৩ হাজার শিশু আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারে

নিখিল মানখিন ॥ দুরারোগ্য ব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু অনিক দত্ত (১২)। সে আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র। এক বছর আগে এই মরণব্যাধিটি ধরা পড়ে। মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে তাকে অপারেশন করা হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শে তার কেমো থেরাপি শুরু হয়েছে। কিন্তু শিশুটির মাতা-পিতার পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিশুটির মাতা-পিতার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। টাকার অভাবে চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনিক দত্ত সুস্থ হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েও চিকিৎসকদের এমন কথা বাড়িয়ে দিয়েছে শিশুটির মাতা-পিতার কষ্টের মাত্রা। এভাবে অনিক দত্তের মতো ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শিশু ক্যান্সারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা সম্ভব। দেশে যে হারে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, তার মাত্র ১০ শতাংশেরও কম রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে। বাকি ৯০ শতাংশ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু যথাযথ চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শিশু ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার চারটিসহ মোট ১০টি সরকারী হাসপাতালে শিশু ক্যান্সার বিভাগ চালু আছে। প্রতিবছর যে সংখ্যায় শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও অবকাঠামো নেই। যেভাবে শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের উপস্থিত বাড়ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক মনে করছেন শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েকবছর আগেও বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের ৯০ শতাংশই মারা যেত। একই সময়ে উন্নত রাষ্ট্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ শিশুই চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১২ সালের আগে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যায় কোন তথ্য ছিল না। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে আমেরিকা ও কানাডা ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভাগ চালু হয়। সেই থেকে ওই দুই কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা ব্লাড ক্যান্সারের এর পরে রয়েছে ব্রেন টিউমার, বোন টিউমার ইত্যাদি। ২০১২ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশনকৃত শিশু ক্যান্সার রোগীর অধিকাংশ এখনও এ বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, চিকিৎসায় ৫৮ শতাংশ রোগী সুস্থ হলেও বাকি ৪২ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। যদিও আশার বিষয় শিশু ক্যান্সারের ৭৫ শতাংশ নিরাময় করা সম্ভব। পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সমীক্ষায় যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা বেশ আশ্চর্যজনক। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মাত্র ৫ শতাংশ বংশগত সূত্রে জিন মারফত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বাকি প্রায় ৯৫ শতাংশ কিন্তু জন্ম পরবর্তীকালে পারিপার্শ্বিক কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা ব্লাড ক্যান্সারের, যা শতকরা ৬০ শতাংশেরও ওপরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা (শিশু ক্যান্সার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া) ক্যান্সার ধরতেই পারছেন না। এর কারণ শিশু ক্যান্সারের আলাদা লক্ষণ, কখনও বা জ্বর, কখনও দেহে বিশেষ চিহ্ন বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া ইত্যাদি আলাদা উপসর্গ থেকে ক্যান্সার দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, জিনগত ক্যান্সার ছাড়া নগরায়নের পরোক্ষ প্রভাবেই শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের ঘটনা বাড়ছে। ভাইরাস, দূষণ আর বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি ক্যান্সারের মূল কারণ। শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিক মাত্রায় শিল্পায়ন, উন্নয়ন শিশুদের শরীরে ক্যান্সার জন্ম দিচ্ছে। আমেরিকা আর কানাডায় শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ ক্যান্সার। ইউরোপে বছরে প্রায় ৭ শতাংশ শিশু ক্যান্সারে মারা যায়। এসব তথ্য থেকেও এটা পরিষ্কার যে, নগরায়ণ আর শিশু ক্যান্সারের বৃদ্ধির মধ্যে সমানুপাতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মোয়াররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যান্সার একটি জটিল রোগ যার কোন নির্দিষ্ট বয়স সীমা নাই। এখনও অনেকে মনে করেন ক্যান্সার বয়স্কদের রোগ, শিশুদের ক্যান্সার হয় না, যা একটা ভুল ধারণা। এটি শুধু বয়স্কদের জন্য নয়, বরং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যে কোন বয়সেই হতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশই ১৮ বছরের নিচে শিশু-কিশোর। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে তারাও আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতিবছর দেশে অনেক সম্ভবনাময় জীবন অকালে ঝরে পড়ছে। সঠিক চিকিৎসায় শিশুদের অনেক ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সংক্রামক রোগে শিশু মৃত্যুর হার কম। এদিকে, ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যান্সারের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর দুই লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৮০ শতাংশই মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে ক্যান্সার আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার মাত্র ৫ ভাগ। অথচ উন্নত দেশগুলোতে এই হার ৮০ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিবছর শনাক্ত হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার নতুন শিশু ক্যান্সার রোগী। দেশে ক্যান্সার রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যাও কম। চিকিৎসাও খুব ব্যয় বহুল। ফলে সব ক্যান্সার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, দেশে প্রায় ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে আবার চার থেকে পাঁচ শতাংশ শিশু রয়েছে। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৩ হাজার শিশু। যদি শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত ধরা হয় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ১২ থেকে ১৮ হাজার। আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংখ্যাও কম। ফলে সব ক্যান্সার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী ।
×